ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ইচ্ছেঘুড়ি

মেন্টাল ভূত (দ্বিতীয় পর্ব)

ইমরুল ইউসুফ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭১৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৭, ২০১০
মেন্টাল ভূত (দ্বিতীয় পর্ব)

প্রথম পর্বের পর

মাঠ থেকে জঙ্গলে ওঠার সময় আমি মেন্টাল বাহাদুরকে বললাম, আমাকে নামিয়ে দাও। আমি একাই ওপরে উঠতে পারবো।

মেন্টাল আমার কথা শুনলো না। ঘাড়ে নিয়েই সে ঢুকে পড়লো ছায়াঘেরা জঙ্গলে। মেন্টালের ঘাড় থেকে নেমেই দেখলাম বিশাল একটি পুকুর। পুকুরে পানি টলটল করছে। মাথা তুলে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য মাছ। মাছ খাওয়ায় ব্যস্ত মাছরাঙা, বক, পানকৌড়ি। জঙ্গলজুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে শতশত পাখি। মুখ তুলতেই দেখি গাছের গর্তে বসে আছে হুতুম পেঁচা। ইয়া বড়ো চোখ আরো বেশি বড়ো করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। মাথাটা নাচিয়ে আমাকে যেন ডাকছে তার কাছে। গাছটির আরো কাছে যেতে গিয়ে শিকড়ে হোঁচট খেলাম। আর অমনি শুনলাম এঁখানে কেঁ রেঁ। আঁমার ঘুঁম ভাঁঙালো কেঁ রেঁ? আমি ভয়ে মেন্টালের কাছে দৌঁড়ে গেলাম। মেন্টালকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, এমন করে কথা বললো কে? মেন্টাল বললো, ভয় নেই। ও হলো বটুয়া ভূত। দিনের বেলায় এ ভূত বটগাছের রূপ ধরে থাকে। যখন রাত হয় তখন এই গাছ ভূতের রূপ ধরে উড়ে বেড়ায় এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। এ বাড়ি  থেকে ও বাড়ি। তোমাদের বাড়ির চারপাশেও সে প্রতিদিন ঘুরে বেড়ায়।

রাত হলেই তোমাদের পুকুর পাড়ের গাব গাছটিতে বসে থাকে। ঐ গাছতলা দিয়ে যারা বেশি রাতে চলাচল করে তাদের বিরক্ত করে। যারাই বেশি রাতে বাড়ি ফেরে তাদের গায়ে পানি ঢেলে দেয়। মাথার ওপর শুকনো কিংবা কাঁচা ডাল ফেলে। গাছের পাতা দিয়ে বল তৈরি করে গায়ে ছুঁড়ে মারে। মাঝে মধ্যে আবার তারা কুচকুচে কালো লম্বা হাত বা পা ঝুলিয়ে দেয় পথচারীর মুখের সামনে। মানুষ তখন ভয়ে দৌঁড়ে পালায়। তবে আমি যদি এর আশপাশে থাকি তাহলে ওরা আমার ভয়ে কারো কিছু করার সাহস পায় না। আমি কোনো কারণে গ্রামের বাইরে গেলেই এমনটি করে। এই কথা শোনার পর আমি বললাম, কিন্তু বটুয়া ভূত কী যে বললো তাতো কিছু বুঝলাম না মেন্টাল। মেন্টাল বললো,  বটুয়া বলেছে, এখানে কে রে। আমার ঘুম ভাঙালো কে রে?

এই কথা শুনে আমি এবার মেন্টালকেই ভয় পেতে শুরু করলাম। বললাম, মেন্টাল পানি খাব। আমাকে পানি দাও। মেন্টাল বললো, চোখ বন্ধ করো আমি এখনই পানি দিচ্ছি। বলতে না বলতেই আমার সামনে একগ্লাস পানি হাজির হলো। আমি আরো অবাক হলাম। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না মেন্টাল বাহাদুর আসলেই ভূত। তবে এখন আমার কিচ্ছু করার নেই। আর কিছু না ভেবে একগ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেললাম। ভীষণ মিষ্টি পানি। এতোটাই মিষ্টি যে গলা তেতো হয়ে যায়। আমার তখন খুব ভয় লাগছিল। কিন্তু আমি এমন ভাব করতে লাগলাম যে আমার মোটেও ভয় লাগছে না। আমার তখন কেবলই বাবা মায়ের কথা মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বাবা মায়ের কথা না শুনে ভুলই করেছি। তারপরও আমি মেন্টালকে সাহস করে বললাম, তুমিও কী ভূত মেন্টাল? মেন্টাল বললো, না। আমাকে দেখে কী ভূত মনে হয়? আমি ভূত না। আমি তোমার মতোই মানুষ। আমি তোমার বন্ধু মেন্টাল। ভূতদের সঙ্গে আমার ভালো খাতির আছে, এই আর কী।

আমি বললাম, তোমার সঙ্গে ভূতের কেমন খাতির তা দেখতে চাই। তুমি এখনই আমার সামনে একটি মামদো ভূত হাজির করো তো দেখি। শুনেছি মামদো ভূতের লম্বা লম্বা হাত পা। ইয়া বড়ো বড়ো চোখ। খাদা নাক। আর মাথায় পরা থাকে সাদা ধবধবে পাগড়ি। মেন্টাল বললো, এখানে তো মামদো ভূত থাকে না। মামদো ভূত থাকে পুরোনো বাড়িতে। উঁচু উঁচু পাহাড়ে। এখানে বাড়িও নেই। পাহাড়ও নেই। এখানে থাকে গেছো ভূত। ভূতগুলো দিনের বেলায় গাছের গুড়ি, ডাল, লতাপাতার সঙ্গে মিশে গাছের রূপ ধরে থাকে। রাত হলেই এরা বেরিয়ে পড়ে। ঘুরতে থাকে এ গ্রাম, সে গ্রাম। এ বাড়ি ও বাড়ি। আর সবচেয়ে ভয়ের কথা হলোÑ এরা সুযোগ পেলেই মানুষের ঘাড় মটকায়। বদ মানুষের চুলের মুঠি ধরে কয়েক পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দেয় শূন্যে। কোনো কোনো মানুষের আবার রক্ত চুষে খায়। তবে সব ভূত যে  দুষ্টু তাও নয়। অনেক ভূত আছে যারা মানুষের বিপদ আপদে এগিয়ে আসে। মানুষের খুব ভালো বন্ধু হয়।

ঠিক আছে মেন্টাল। তুমি যদি আমার বন্ধু হও তাহলে এখনই আমাকে এ জঙ্গল থেকে নিয়ে যাও। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও। মেন্টাল বললো, তোমাকে অবশ্যই বাড়িতে পৌঁছে দিব। তবে ভূতের চেহারা না দেখিয়ে তোমাকে তো আর নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। চলো তোমাকে শেওড়া ভূতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। আমি বলালাম, শেওড়া ভূতের সঙ্গে দেখা করার আমার কোনো দরকার নেই। মেন্টাল বললো, আছে। তুমি না ভূতের চেহারা দেখতে চেয়েছিলে। ভূতের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে? আমি বললাম, তাতো চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার ভয় করছে।
 
ভয়ের কোনো কারণ নেই। এই কথা বলে মেন্টাল আমাকে আরো গহীন জঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। নিবিড় ঘন কালো ঝোপের কাছে যেই না পৌঁছেছি আমার মাথার ওপর পড়লো ছোট একটি ডাল। ভয়ে আমি লাফিয়ে উঠলাম। মেন্টালকে জড়িয়ে ধরলাম। মেন্টাল বললো, শেওড়া ভূত এমনই। মানুষ দেখলেই এরা গাছের ডাল পাতা ফেলে তাকে অভিনন্দন জানায়। তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তুমি এখন শেওড়া ভূতের সঙ্গে কথা বলতে পারো। আমার কোনো কথার জবাব না পেয়ে মেন্টাল বললো, ভূতং ভাইয়া তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এ হলো আমার বন্ধু ইমু। ও তোমাকে দেখতে চায়। তুমি এখনই গাছ থেকে নেমে এসো।
 
ও, তুমি তোমার বন্ধুকে এখানে বেড়াতে নিয়ে এসেছো? তাহলে তো নামতেই হয়। বলতে না বলতেই গাছটি ভূত হয়ে গেলো। সাদা ধবধবে কাপড় পরা একটি ভূত দাঁড়ালো আমার সামনে। কালো জঙ্গল সাদা কাপড়ের আলোয় ভরে উঠলো। ভূতটি এতোটাই বড়ো যে আমি ঘাড় উঁচু করেও তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু তার কালো হাত পা দেখতে পাচ্ছিলাম। শেওড়া ভূত আমার নাম, বাড়ি কোথায়, আমার বাবা মা কী করেন তা জানতে চাইলো। আমার সব কথা শুনে ভূত নাঁকি সুরে বললো, ইঁমু বাঁবু, তোঁমার সাঁহস দেঁখে আঁমি অঁবাক হঁয়েছি। এঁমন সাঁহসি মাঁনুষদেরই আঁমরা বেঁশি পঁছন্দ কঁরি। সঁময় পেঁলেই তুঁমি এঁখানে মেঁন্টালের সঁঙ্গে বেঁড়াতে এঁসো। তঁবে বাঁবা মাঁকে নাঁ জাঁনিয়ে এঁভাবে আঁর এঁসো নাঁ। তুঁমি এঁখনই বাঁড়ি ফিঁরে যাঁও। তোঁমার বাঁবা মাঁ তোঁমাকে কোঁথাও নাঁ পেঁয়ে ভীঁষণ অঁস্থির হঁয়ে পঁড়েছেন। মেঁন্টাল তুঁমি এঁখনই ইঁমু বাঁবুকে বাঁড়ি পৌঁছানোর ব্যঁবস্থা কঁরো। এই কথা বলে ভূতটি মুহূর্তেই আবার গাছ হয়ে গেল।

আমি যখন বাড়ি ফিরে গেলাম তখন প্রায় বিকেল। মেন্টালকে আমাদের বাড়ির আশপাশে ঘেঁষতে দিলাম না। কারণ বাবা মা জানতে পারলে দুজনকেই আস্ত রাখবেন না। বাড়ির সবাই জানতে চাইলেন আমি এতোণ কোথায় ছিলাম। বললাম, আমি ছিলাম বন্ধু রাফিনের বাড়ি। খালামনি না খেয়ে কিছুতেই আসতে দিলেন না, তাই দেরি হয়ে গেল। বাবা মা বললেন, এমনটি যেনো আর কখনো না করি। আমি মাথা নেড়ে ঘরে ঢুকে গেলাম।
    
এই ঘটনার পর মেন্টালের সঙ্গে আমার বহু বছর দেখা হয়নি। শুনেছি সে পাশের গ্রামে হামিদ মাস্টারের বাড়িতে থাকে। তাদের গরুবাছুর রাখে। মেন্টালের একদিনের ঘটনা মনে হলে আমার গায়ে এখনো কাঁটা দেয়। ইউনিভার্সিটির গরমের ছুটিতে বাড়ি ফিরছি। গাড়ি থেকে যখন নামলাম তখন অনেক রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তায় ভীষণ কাদা। ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে জুতা খুলে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে এগুতে লাগলাম। রাস্তায় কোনো লোকজন নেই। নির্জন রাস্তায় ব্যাঙের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আমি হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ভয়ের জায়গা বাঁশতলায় চলে এলাম। বাঁশতলা জুড়ে কবরস্থান। কিছু কবর পাকা। আর কিছু কবর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। যেইনা বাঁশতলা পেরিয়েছি অমনি দেখলাম আমার সামনে সাদা একটি কাপড় পড়ে আছে। অন্ধকার রাতে কাপড়টি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোনো উপায় না দেখে আমি কাপড়ের ওপর দিয়েই হেঁটে যেতে চাইলাম। আর তখনই কাপড়টি আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। ভয়ে আমি যেনো কাঠ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হচ্ছে না। বুঝলাম গেছো ভূতের পাল্লায় পড়েছি। ভূত তার নাঁকি সুরে বললো, কিঁরে ছোঁকড়া এঁতো রাঁতে কোঁথা থেঁকে এঁলি? তুঁই জাঁনিস নাঁ এঁতো রাঁতে এঁ রাঁস্তায় আঁসা নিঁষেধ? আমি শুধু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। তারপর আবার ভূত বললো, তাঁহলে এঁসেছিস কেঁন? দাঁড়া দেঁখাচ্ছি মঁজা। তোঁর আঁজ ঘাঁড় মঁটকাবো। তোঁর কাঁছে যাঁ আঁছে সঁব দিঁয়ে দেঁ বঁলছি। তুঁই আঁসার সঁময় জাঁমতলা থেঁকে মিঁষ্টি এঁনেছিস নাঁ? সেঁই মিঁষ্টির প্যাঁকেটটা আঁগে দেঁ। কঁতো দিঁন মিঁষ্টি খাঁই নাঁ!

কাঁপা কাঁপা হাতে যেই না ব্যাগে হাত দিয়েছি অমনি আমার কানে মেন্টাল বাহাদুরের কথা ভেসে এলো। মেন্টাল বললো, কী হয়েছে ইমু বাবু? আমি কোনো জবাব দেয়ার আগেই মেন্টাল বললো, বুঝেছি গেছো ভূত তোমাকে বিরক্ত করছে। কোনো ভয় নেই। আমি দেখছি। মেন্টাল তখন বললো, ভূতং ভাইয়া ও কিন্তু আমার বন্ধু। ওকে বিরক্ত করো না। ওকে বাড়ি যেতে দাও। গেছো ভূত তাদের ভাষায় বললো, তোঁমার বঁন্ধু আঁগে বঁলবে নাঁ? আঁগে জাঁনলে তোঁ তাঁকে বিঁরক্ত কঁরতাম নাঁ। তুঁই তাঁকারি কঁরে কঁথা বঁলতাম নাঁ। দুঃখিত ইঁমু, যাঁও বাঁড়ি যাঁও। মেঁন্টাল ওঁকে এঁখনই বাঁড়ি পৌঁছে দিঁয়ে এঁসো। শোঁনো ইঁমু আঁর কঁখনো এঁতো রাঁতে এঁ পঁথ দিঁয়ে যাঁতায়াত কঁরবে না। ঠিঁক আছে? আমি শুধু হু্যঁ বললাম। মেন্টাল বললো, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। মেন্টাল আমাকে দ্রুত আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিলো।

মা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, এতো রাতে একা কেমন করে এলি? আমি বললাম, ভীষণ বিপদে পড়েছিলাম মা। মেন্টাল বাহাদুর না থাকলে আজ আমি বাড়ি পৌঁছাতে পারতাম না। কী বললি মেন্টাল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেছে? বলিস কী? মেন্টাল তো বেশ কয়েকদিন আগেই মারা গেছে। তুই ঠিক দেখেছিস তো? মায়ের এই কথা শুনে আমি ভীষণ অবাক হলাম। ভয়ে আমার হাত পা যেনো আরো ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগলো।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।