ঢাকা, রবিবার, ১৪ পৌষ ১৪৩১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

খুকুমণি ও বিড়ালছানা মিনি

মীর আব্দুল আউয়াল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৩
খুকুমণি ও বিড়ালছানা মিনি

পৌষের শীতের সন্ধ্যা। বাড়ির কর্তা রহিম মিয়া তখনও বাসায় ফেরেbনি।

গৃহকর্ত্রী হালিমা বেগম চিন্তায় অস্থির। কোনোদিন রহিম বাসায় ফিরতে এত দেরি করেন না। আজ ক’দিন হলো দারুণ শীত পড়েছে। এ হাড় কাঁপানো শীতে বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছে না। একমাত্র মেয়ে তাহমিনা বাবাকে না দেখতে পেয়ে কান্না-কাটি শুরু করেছে। মেয়েটা মায়ের চেয়ে তার বাবাকে বেশি ভালোবাসে।

তাহমিনার বয়স এখন চার বছর। ফুটফুটে দেখতে হওয়ায় আদর করে সবাই। আগামী বছর তাকে ইস্কুলে দেয়ার চিন্তা ভাবনা করছেন রহিম মিয়া। অফিসের সামান্য এক পিওন হলেও তার অনেক সুনাম। ভদ্র আর বিণয়ী হওয়ায় তাকে সবাই ভালোবাসে।

m22রাতের রান্না শেষ হয়েছে। হালিমার এখন একটু অবসর। শীতের মধ্যেও তাকে তিন বেলা গরম রান্না করতে হয়। কারণ রহিম মিয়া আবার গরম গরম খেতে বেশি পছন্দ করেন। রহিম মিয়াও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলেন। অনেক আদরে মানুষ হয়েছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন এক অফিসের কেরানি। তার ইচ্ছা ছিল রহিম মিয়া লেখাপড়া শিখে তার চেয়েও অনেক উপরে যাবে। কিন্তু বাবার অকাল মৃত্যু হওয়ায় পড়াশোনায় কাশেম মন্ডল আর বেশি দূর যেতে পারেন নি। কিন্তু বাবা-মায়ের কাছ থেকে ভদ্রতা শিখতে পেরেছিলেন। এটাই তার এখন বড় মূলধন।

-    আচ্ছা মা, আজ বাবা এত দেরি করছে কেন?
-    এইতো এখনই এসে পড়বে মামণি।
-    আমার আর ভালো লাগছে না মা।
এরই মধ্যে সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। হালিমা দ্রুত গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রহিম মিয়াকে দেখেই চমকে উঠলো হালিমা। কারণ তার কোলে একটি বিড়াল ছানা তখন মিউ মিউ করছে। রহিম মিয়া বিড়াল ছানাটি তাহমিনার কাছে দিতেই ছানাটিকে আদর করতে আরম্ভ করলো সে। তার মা হালিমা যেভাবে তাকে আদর করে ঠিক সেভাবে সে বিড়ালছানাটিকে আদর করতে লাগলো। এ দৃশ্য দেখে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন তাদের আদরের খুকুমণির দিকে।

m120রাতে খাবার শেষে খুকুমণি বিড়ালছানাটিকে তার লেপের মধ্যে নিয়ে অনেক আদরে ঘুম পাড়াতে লাগলো। লেপের গরমে বিড়ালছানাটি লেপের মধ্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই মনের সুখে আরামপ্রকাশক গরগর শব্দ করতে লাগলো। খুকুমণির তখন থেকেই একমাত্র চিন্তা কীভাবে ছানাটি আরাম পাবে।

খুকুমণি রাতেও বিড়াল ছানাটির দেখভালে যাতে কোনো ক্রুটি না হয় সেজন্য অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বিড়াল ছানাটির খোঁজ নেয়। বিড়ালছানাটি তখনও লেপের নিচে ঘুমাচ্ছিল। তাকে ডেকে তোলা ঠিক হবে না ভেবে সে নিজে বিছানা থেকে উঠে মায়ের কাছে তার খানাপিনার জন্য দুধভাতের কথা বললো। তারপর দুধভাত নিয়ে সে বিড়ালছানাটিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে খেতে দেয়। বিড়ালছানাটি আনন্দে দুধভাত খেতে থাকে আর মিউ মিউ করে আদর জানাতে তাকে। বাবা-মাকে এখন আর খুকুমণি কোনো বিরক্ত করে না।

সেদিন শুক্রবার। অফিস বন্ধ। দুপুর গড়িয়ে গেছে। রান্নাঘরে হালিমা বেগম একাকী রান্নাবান্না করছেন। রহিম মিয়া বাসায় বসে নানাবিধ চিন্তায় ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন।   হঠাৎ তাহমিনার চিৎকারে বাসার সবাই তার কাছে আসলেন। তাহমিনা তখন অঝোরে কান্নাকাটি করছে। কোনো কিছুই গুছিয়ে বলতে পারছেনা সে।

-    মা, ওমা, আমার বিড়ালছানা মিনিকে আমি খুঁজে পাচ্ছি না। একটু আগেও সে এখানে ছিল। আমি একটু বাইরে গিয়েছি আর এসে দেখি ও এখানে নেই।
-    ওকে পাওয়া যাবে না মা।
-    তুমি অতো অধৈর্য হয়ো না লক্ষ্মীটি।
-    না মা, তা হবে না। আমি আমার মিনিকে চা-ই চাই। আমি কিচ্ছু বুঝিনা।

অবশেষে বাসার চারপাশ খোঁজা হলো। কিন্তু কোথাও মিনিকে পাওয়া গেল না। কেউ বলতে পারে না মিনির খোঁজ। সবারই ধারণা কোনো দুষ্ট ছেলে একাজ করেছে। অর্থাৎ মিনিকে চুরি করে অন্য কোথাও নিয়ে গেছে।

m32বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলেও মিনির খোঁজ পাওয়া গেল না। এদিকে তাহমিনাকে কিছুতেই খাওয়ানো যাচ্ছে না। তার একই কথা, আমি আমার মিনির সাথে দুধভাত খাব। রাতে খুকুমণির জ্বর এলো। শেষ রাতের দিকে প্রচণ্ড জ্বরে তাহমিনা কাঁদছিল। জ্বরের প্রকোপে সে প্রলাপ বকে চলছিল। তার মুখে শুধু একটাই বুলি, আমার মিনিকে তোমরা এনে দাও।

ভীষণ বিপদে পড়ে যান তাহমিনার বাবা-মা। দুপুরের দিকে হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। ডাক্তার আদ্যোপান্ত শুনে তাদের একটা বিড়াল ছানা জোগাড় করতে বললেন। বিড়ালছানা জোগাড় হলে তা তাহমিনার সামনে আনা হলো।

-    মামণি দেখ, মিনি এসেছে। দেখ কেমন করে তোমার দিকে চেয়ে মিউ মিউ করছে।
-    না মা, না। এটা আমার মিনি না। আমার মিনির মুখে কাল দাগ ছিল। তোমরা আমার মিনিকে নিয়ে এসো।

অবশেষে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হাসান আরিফ জ্বরের লক্ষণ ভালো নয় বলে মত প্রকাশ করলেন। জ্বর কমার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

গভীর রাত হাসপাতালে হঠাৎ তাহমিনা বলে উঠলো, আমার মিনিকে পেয়েছি মা, ওই দেখ সে কেমন করে আমার দিকে চেয়ে আছে।

m42এ কথা শুনে  চিন্তায় পড়ে যান মা হালিমা বেগম। তিনি তাড়াতাড়ি জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত ডাক্তারে শরণাপন্ন হন। কিন্তু সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলো খুকুমণি।

দিনটা ছিল সোমবার। এরই মধ্যে খুকুমণির মৃত্যুর এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। খুকুমণির মৃত্যুর পর আরেকটি বিড়ালছানা এনে বাসায় পুষতে থাকেন হালিমা বেগম। মেয়ের মতোই তিনি তাকে সেবা যতœ করে বড় করে তুলেছেন। বিড়ালটির বয়স দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। সে সব সময় হালিমার কাছে কাছে থাকে আর মিউ মিউ করে আদর জানায়।

অফিসের ফাঁকে দুপুরে খেতে এসেছেন কাশেম মন্ডল। তিনি এসে দেখেন হালিমা উদাসীন হয়ে দাওয়ায় বসে পা ছড়িয়ে বসে আছে। রান্না-বান্নার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। হেঁসেল ঘরে তখনও তালা ঝুলছিল।
-    কী ব্যাপার রান্না-বান্না কিছু হয়নি নাকি?
-    জানি না। আর কোনো উত্তর দিলেন না হালিমা।

হঠাৎ হাউ মাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন হালিমা। কোলে বিড়ালছানাটি। খুব মনে পড়ছে তাদের আদরের খুকুমণিকে। চোখ শুধু ঘুরে-ফিরে দেখছে দেয়াল-ঘরজুড়ে খুকুমণির স্মৃতিচিহ্নের দেখে।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৩
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।