ঢাকা, শনিবার, ১৩ পৌষ ১৪৩১, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

মীম নোশিন নাওয়াল খান-এর গল্প

আনা এবং ঋতুর বুড়িরা

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪
আনা এবং ঋতুর বুড়িরা

মেঘের রাজ্য থেকে আরও দূরে একটা ছোট্ট বাড়ি। বাড়ির চারপাশে বাগান, আছে একটা ছোট্ট কুয়া।

বাগানের চারদিকের চার আবহাওয়া। একদিকে সারা বছর শীতকাল, একদিকে গ্রীষ্ম, আর দুদিকে বসন্ত ও শরৎ। আসলে এই বাড়িটা চার বোনের- গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্তের। অনেক অনেকদিন ধরে তারা এখানেই বাস করছে।

এই চার বোন কবে থেকে এই বাড়িতে বাস করে সেকথা কেউ বলতে পারে না। আকাশের তারা, মেঘমালা, এমনকী চাঁদ মামা- সবাই নাকী চার বোনকে সেই শুরু থেকেই এরকম খুনখুনে বুড়ি দেখছে। আর সবচেয়ে বুড়ো যে সূর্য, সূর্যও বলে সে নাকী প্রথম থেকেই এই বোনদের দেখে আসছে। এদের মধ্যে কে বড়, কে ছোট- সেটা সূর্যও জানে না।

চার ঋতু বোনের মধ্যে ভারী ভাব। তারা সারাদিন একসাথে গল্প করে, মিলেমিশে রান্না করে, কুয়া থেকে পানি আনে। নিজেরাই শাক-সবজি ফলায় বাগানে। আছে ফুল-ফলের গাছও। বাগানে চারটা ঋতু একসঙ্গে থাকে বলে তারা সব ঋতুর আবহাওয়া, ফল-ফুল, সবজি সবসময়ই পায়।

পৃথিবীতে যে ঋতু পরিবর্তন হয়, এর পেছনেও আছে এই বুড়িদের ভূমিকা। ঋতু পরিবর্তন নিয়ম বেঁধে হয়। যখন শীতকাল আসার কথা, তখন শীতের বুড়ি তুষার-সাদা ভাল্লুকে টানা গাড়ি করে নেমে আসে পৃথিবীতে। ছিটিয়ে যায় কিছু শীতের পরশ। কিছুদিন থেকেও যায়। তারপর চলে যায়। কিন্তু রয়ে যায় তার ছড়িয়ে যাওয়া শীত।


শীতের পর বসন্ত ঋতুর আসার কথা। তাই নির্দিষ্ট সময়ে ফুলে সাজানো রথে করে বসন্ত বুড়ি পৃথিবীতে যায়, বসন্তের পরশ ছিটিয়ে চলে আসে।

বসন্তের পর আগুনের বাহনে আসে গ্রীষ্ম বুড়ি, তারপর মেঘের ভেলায় চড়ে শরৎ বুড়ি।

সব দেশে চারটা ঋতু থাকে না, আবার সব দেশে একই সঙ্গে একই ঋতুও থাকে না। তাই বুড়িদের একেক দেশে গিয়ে একেক ঋতু ছিটিয়ে আসতে হয়। আর যে দেশে যেই ঋতু নেই, সে দেশে সেই ঋতুর বুড়ি যায় না। আবার কিছু দেশে আরও দুটো ঋতু আছে- হেমন্ত ও বর্ষা। সেই ঋতু দুটো আনার জন্য বুড়িরা একাধিক ঋতু ছিটিয়ে দেয়। গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি হয়, ঝড় হয়। বসন্তে প্রকৃতি থাকে সতেজ, সবুজ। তাই বর্ষাকাল তৈরির জন্য গ্রীষ্মবুড়ি আর বসন্তবুড়ি একসঙ্গে ঋতু ছিটিয়ে দেয়। আবার হেমন্ত আনতে শরৎবুড়ি আর শীতবুড়ি ঋতু ছেটায়। এভাবেই পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়।

ইংল্যান্ডে তখন শীতকাল চলছে। সে দেশের এক গ্রামে থাকত আনা নামের এক কিশোরী। বাবা-মা কেউ ছিল না তার। সে থাকত ছোট্ট কুঁড়েঘরে। সারা বছর বনে কাঠ কুড়াতে যেত সে, কুয়া থেকে আনত পানি। শীতে, গ্রীষ্মে খুব কষ্ট হতো তার।
একদিন আনা বনে গিয়েছিল কাঠ কুড়াতে। শীতে কাঁপছিল সে। গায়ে কোনো গরম জামাও ছিল না। শীতের বুড়ি তখন সেই বনেই ছিল। গাছের উপর ছোট্ট কুঁড়েঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল কেউ বলছে, আর যে পারি না! কেন যে প্রতি বছর শীত আসে! জমে যাচ্ছি যে। এরকম চলতে থাকলে তো মরেই যাব। হে ঈশ্বর, তুমি কিছু করো।

শীতের বুড়ি কৌতূহলী হয়ে নিচের দিকে তাকাল। আর তখনই সে দেখতে পেল আনাকে। সে হাড়কাঁপানো শীতে একটা ফ্রক পরে মাথায় স্কার্ফ বেঁধে শুকনো ডাল কুড়োচ্ছিল। বুড়ির খুব মায়া হলো। সে উপর থেকে তাকে ডেকে বলল, হ্যাঁগো মেয়ে, কে তুমি? তোমার খুব শীত করছে বুঝি? গরম জামা পরোনি কেন? শীতকালে গরম জামা না পরলে যে শরীর খারাপ করবে, সেকথা জানো না বুঝি?

আনা অপরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল খুনখুনে বুড়িকে। সে বলল, আমি আনা। নাগো বুড়িমা, আমি তো অনেক গরিব, তাই শীতের জামা কিনতে পারিনে। শীতকাল বড় কষ্টে কাটে গো।
একথা শুনে শীতের বুড়ির খুব কষ্ট লাগল। কিন্তু কী-ই বা করবে সে? তার কাছে আনাকে ডাকতে পারল না। তার কাছে এলে ঠাণ্ডায় জমেই যাবে মেয়েটা। সে একটা গরম জামা ছুঁড়ে দিল আনার দিকে। বলল, ওটা পরে নাও। আচ্ছা মেয়ে, গ্রীষ্মকাল হলে তোমার বুঝি ভালো হয়?

বুড়িকে ধন্যবাদ দিয়ে আনা বলল, না বুড়িমা, গ্রীষ্মকালে সেকী গরম গো! প্রাণটা বেরিয়ে যায় যে। অমন গরমে বনের মধ্যে কাঠ খুঁজে বেড়ানো কী চাট্টিখানি কথা গো?
শীতে বুড়ি বলল, তবে বুঝি শরতে তুমি ভালো থাকো?

সে একটু শরীর ঠিক থাকে, তাতেই বা কী! তখন যে মাঠে কাজ করে খেটে মরতে হয়।

-তাহলে বসন্তে?

-তখন তো দম ছাড়ার ফুসরত পাই না গো। ফুল তুলি, মালা গাঁথি, বিক্রি করি- তবে না খাবার কেনার পয়সা জোটে।

শীতের বুড়ির খুব মন খারাপ করল। সে আনার সব কথা শুনল। তারপর নিজের পরিচয় প্রকাশ করে বলল, তুমি বরং আমার সঙ্গে আমাদের বাড়িতে চলো। ওখানে খুব ভালো থাকবে তুমি।

আনা রাজি হয়ে গেল। শীতের বুড়ির সঙ্গে মেঘের উপরে তাদের বাড়িতে চলে গেল সে। সেখানে সে অনেক ভালো ছিল। চার বোনই তাকে খুব আদর করত। এভাবে আস্তে আস্তে সময় গড়াল, কয়েক বছর পেরিয়ে গেল। তখন চার বুড়ি মিলে একদিন তাকে বাগানে সবজি তুলতে পাঠিয়ে আলোচনা করতে বসল। গ্রীষ্মবুড়ি বলল, সে এখানে ভালো আছে। কিন্তু এখানে থাকলে তো তার বয়স বাড়বে না। সে পৃথিবীর সন্তান, এভাবে তো চলতে পারে না। প্রকৃতির নিয়মেই তার বয়স বাড়তে হবে।

তখন শরৎবুড়ি বলল, কিন্তু পৃথিবীতে পাঠালে তো তাকে দেখার কেউ থাকবে না। তার জন্য কোনো ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।

শীতবুড়ি বলল, আমার মত হচ্ছে তাকে ভালো কোথাও বিয়ে দিয়ে তার বরের হাতে সব দায়িত্ব তুলে দেওয়া।

সেটাই করব আমরা। তার বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা আমরা করব। তাকে সুপাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবো। -বলল বসন্তবুড়ি।

চারজনই এই সিদ্ধান্তে একমত হলো।

চাঁদ-তারা, সূর্য-মেঘ, ফুল-পাখি- সবাইকে দায়িত্ব দেওয়া হলো আনার জন্য ভালো পাত্র খোঁজার। অবশেষে এক যুবকের সন্ধান নিয়ে এলো ঈগল। বলল, তার বাবা-মা কেউ নেই। বেশি টাকা-পয়সাও নেই। সে একটা সরাইখানায় কাজ করে। আয়ও সামান্য। তবে সে সৎ এবং পরিশ্রমী।

যুবকটির কথা শুনেই ভালো লেগে গেল চার বোনের। তারা ছদ্মবেশে গিয়ে যুবকটিকে দেখে এল। সত্যিই খুব ভালো ছিল সে। এরপর সেই যুবকের সম্মতিক্রমে তার সঙ্গে আনার বিয়ে দিল চার বোন। সেই বিয়ের আয়োজন হলো তাদের বাড়িতেই। সেখানে অনেক উপহার নিয়ে উপস্থিত হলো চাঁদ-তারা-সূর্য, মেঘ, ফুল পাখিরা।

শরৎ বুড়ি আর বসন্তবুড়ি মিলে পুরো বিয়ের সব খরচাপাতি বহন করল। শীতের বুড়ি নবদম্পতিকে পৃথিবীর বুকে একটা ছোট্ট বাড়ি উপহার দিল। গ্রীষ্মবুড়ি দিল একটা বাগান।

তারপর আনা এবং তার স্বামী পৃথিবীতে ফিরে এল। অনেক পরিশ্রম করল তারা। গ্রীষ্মবুড়ির উপহার দেওয়া বাগানটাতে শাক-সবজি ফলাল, ফুলের চাষ করল, লাগাল ফলগাছও। ফুল আর সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত তারা। অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজেদের অনেক আয়-উন্নতি করল।

প্রতি বছর পৃথিবীতে এলেই ঋতু বুড়িরা তাদের দেখতে যেত, আর অনেক আশীর্বাদ করত। এরপর থেকে যতদিন এই দম্পতি বেঁচে ছিল, অনেক সুখেই ছিল তারা।

নিজেদের জীবনের এই গল্প শুনিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করেছিল আনা ও তার স্বামী। তাদের মৃত্যুর পর তাদের ছেলেমেয়েরা এই গল্প শোনাল তাদের সন্তানদের, তারপর তারা তাদের সন্তানদের। এভাবেই ঋতু বুড়ি বোনদের কথা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, মানুষের মুখে মুখে ফিরল এ গল্প, যুগে যুগে ঋতুর বুড়িরা বেঁচে রইল মানুষের মনে।   

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।