ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

হারাতে হয় ।। কিঙ্কর আহ্সান

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৪
হারাতে হয় ।। কিঙ্কর আহ্সান

মন খারাপ তমালের। সারা শরীরে ব্যাথা।

একটু আগে বোমবাস্টিং খেলা হয়েছে। সবার চেয়ে ছোট সে। বল মেরে তাই সবাই পিঠের অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। কান্না পাচ্ছে খুব। একটু যেন কাঁদেও তমাল। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।

বিকেলে এক ঘণ্টা খেলার নিয়ম। সন্ধ্যে হলেই ফিরতে হয় বাড়ি। গণিত পড়াতে এসময় শ্যামল স্যার আসেন। কড়া শিক্ষক তিনি। পড়া না পারলে কঠিন ঝাড়ি খেতে হয়। প্রথম দিন পড়াতে আসবার সময়ই তমালের মা শ্যামল স্যারকে বলেছেন, ‘পড়া না পারলে ছেলেরে পিটায়ে লম্বা বানায়ে ফেলবেন। আমার ছেলে চাই না। পড়াশোনা চাই। ’

কি নিষ্ঠুর মা! মায়ের সেই কথা শুনে শ্যামল স্যার মারেন না অবশ্য কিন্তু বকাঝকা করেন খুব। বকাঝকার কারণও আছে। তমাল অঙ্কে একটু বেশি রকমেরই খারাপ। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অঙ্কে একশতে সাঁইত্রিশ পেয়েছে সে। কোনোরকমে টেনেটুনে পাস। লজ্জার ব্যাপার।

তমালের বাবা থাকেন বেনাপোলে। তার বদলির চাকরি। দুই সপ্তাহ পর পর ছুটির দিনে বাড়িতে আসেন। এসেই তমালকে ধমকান। বলেন, ‘আমি ছিলাম অঙ্কে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। আর আমার ছেলে কিনা পায় সাঁইত্রিশ! ছি ছি এই লজ্জা কোথায় রাখি। ’

সবার এমন লজ্জ্বা পেতে দেখে অবাক লাগে তমালের। অঙ্কে সাঁইত্রিশ পেয়েছে বলে এত লজ্জ্বার কি আছে বোঝে না। ইংলিশ কিংবা বাংলাতে সবসময় আশির ওপর যখন পায় কই তা নিয়ে তো কথা বলেনা কেউ। গত পরীক্ষায় ‘সলোমান গ্রান্ডে, বর্ন অন মানডে। ’ নামে যে কবিতাটা লিখেছিলো তাতে একটা বানানও ভুল হয়নি। এসব নিয়ে লজ্জ্বা-ফজ্জ্বার কথা কেন বলে না শুনি?

‘খুক ফুক, খুক ফুক..’ করে অভিমানে তমাল এবার কাঁদতে শুরু করে। আহারে ছোট বলে তার কতই না দুঃখ। সবাই তাকে অবহেলা করে। কেউ ভালোবাসে না।

সন্ধ্যে নামবে নামবে ভাব। আকাশ কালো হয়ে এসেছে। কতকগুলো কাক উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। আজকাল ঝড় হয় খুব। কালবোশেখি ঝড়। প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই জোর বাতাস বয়। বাড়িতে যেতে হবে দ্রুত। বাবা আসবেন আজ । তার মানে স্যারের ঝাড়ি খাবার পর রাতে আবার বাবা বকবে। হায়রে কপাল!

তবে হ্যাঁ, বাবা লোকটা খুব একটা খারাপ নন। বকেন ঠিকই কিন্তু বাড়িতে আসলে প্রতিবারই তার জন্য একটা গল্পের বই নিয়ে আসেন। মা ও ভালো। বাসায় ফ্রায়েড চিকেন, আর রাইস কি সুন্দর করেই না রাঁধেন।  

পিঠে ব্যাথা নিয়ে তমাল হাঁটতে থাকে। বাড়ি থেকে খেলার মাঠটা দূরে। কীর্তনখোলা নদী ঘেঁষে মাঠ। প্রায়ই বল গিয়ে পড়ে নদীতে তারপর রাতের টানে কই না কই ভেসে যায়! রাতের এতই টান যে বাঁশের আঁকসি দিয়ে টেনেও বল ফেরত পাওয়া যায় না।

কীর্তনখোলার পাড়ে ট্রলারের ভীড়। কয়েকটা ট্রলার ছাড়বে এখনই। ঝড়ো হাওয়া নিয়ে তাদের যেন কোনো মাথাব্যাথা নেই। ট্রলারভর্তি মালামাল, লোকজন। লোকজনের চোখ এড়িয়ে একটা ট্রলারে উঠে বসে আচমকা তমাল। তার কেন জানি আজ শ্যামল স্যারের ঝাড়ি খেতে ইচ্ছে করে না। বাবা-মাকে লজ্জ্বা দিতে ইচ্ছে করে না। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সবার কাছ থেকে। মাঝে মাঝে হারাতে হয়। আজ সে হারাবেই।  

রাত নেমেছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। তমালের মা-বাবার কথা মনে পড়ে। মায়ের সাথে ছাড়া সে ঘুমাতেই পারে না। মায়ের শরীরের ঘ্রাণ নিয়ে যখন ঘুমাতে যায় তখন দৈত্যি, দানো কেউই আর তাকে ভয় দেখানোর সাহস পায়না। বাবাও ভালো। গত জন্মদিনে তাকে একটা সাইকেল কিনে দিয়েছেন। ট্রলার ছাড়ে। চলতে থাকে।

চলতে চলতে পৌঁছে যায় মাঝ নদীতে। ঢেউ খুব। ট্রলারের কোন এক কোণায় লুকিয়ে বসে থাকে তমাল। ‘খুক ফুক, খুক ফুক..’ করে কাঁদে। মা-বাবার কাছে যেতে ইচ্ছে করে। সে বোঝে হারাতে হয় না। প্রিয় মানুষদের ছেড়ে হারাতে নেই। হারাতে হয় কথাটা ভুল। ছোটদের জন্য তো ভীষণ বড় ভুল।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৮, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।