ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

তোমাকে আর কষ্ট দেব না মা ।। মীম নোশিন নাওয়াল খান

ইচ্ছেঘুড়ি/গল্প | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৮ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৪
তোমাকে আর কষ্ট দেব না মা ।। মীম নোশিন নাওয়াল খান

রুতু একটা ছোট্ট পেঁচার নাম। ও ওর মায়ের সঙ্গে একটা গাবগাছে থাকে।

গাছটাতেই ওদের বাসা।  
রুতু ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে। মামণির সব কথা শোনে। রাত নামলে মামণি যখন খাবার খুঁজতে বেরোয়, তখন সে বাসা থেকে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দিয়ে বাইরেটা দেখতে চেষ্টা করে। এই কাজটা করতে দারুণ লাগে ওর। ও উঁকি দিয়ে দেখতে পায় ফুলেরা কীভাবে পাতার কোলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে, পাতাগুলোও কেমন ঘুমে নুয়ে পড়েছে। আকাশের তারাগুলোকে গান গাইতেও দেখে ও। বাতাস ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ছুটে চলে, চাঁদ ঘুমন্ত গাছের পাতা আর ঘাসের উপর মায়াবী স্নেহের চাদর বিছিয়ে দেয়। এই সবকিছু দেখতে কী যে ভালো লাগে রুতুর!

একদিন সন্ধ্যার কথা। সূর্য ঘরে ফিরে যাওয়ার পর যখন আকাশে চাঁদ উঠল, তখন রুতুর মামণি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। যাওয়ার আগে সে রুতুকে বলল, ‘শোনো রুতু, তুমি কিন্তু মোটেও দুষ্টুমি করবে না, লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবে। তুমি বাসার ভেতরে খেলা করো, আমি খাবার নিয়ে ফিরে এসে তোমাকে খাইয়ে দেব। ঠিক আছে?’

রুতু লক্ষ্মী মেয়ের মতো মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে মামণি। ’
মামণি চলে যাওয়ার পর রুতু একা একা আকাশের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করল। এমনি সময় একটুখানি বাতাস এসে রুতুকে আদর করে দিয়ে বলল, এই যে ছোট্ট পেঁচার ছানা, তুমি কী জানো আজকে মা দিবস? তুমি কী তোমার মাকে কোনো উপহার দিয়েছ?
রুতু অবাক হয়ে বলল, তাই? আমি জানতাম না তো। মাকে কোনো উপহারও দিই নি। তুমিই বলো না বাতাস ভাইয়া, মাকে কি উপহার দেওয়া যায়।

বাতাস কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তুমি তোমার মাকে একটা ফুল উপহার দিতে পারো।
-কিন্তু সেটা কোথায় পাবো আমি?
-তার জন্য বাসা থেকে বেরুতে হবে। বেশি নয়, অল্প একটু উড়লেই দেখবে অনেক ফুলের ঝোপ রয়েছে। সেখান থেকে পছন্দমতো একটা নিয়ে নিলেই হবে। বলল বাতাস। তারপর সে রুতুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

রুতু অনেক ভেবে দেখল, অল্প একটু উড়লে এমন কোনো ক্ষতি হবে না। মামণির জন্য একটা ফুল আনতে এইটুকুন সে উড়তেই পারে। তাই সে সাহস করে বাসা থেকে উড়াল দিল। ছোট্ট ডানায় ভর করে বেশ খানিকটা দূরে চলে এলো সে। কিন্তু যে কটা ফুলের ঝোপ সে পেল, সবগুলো ফুলই ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই রুতু একটা দুর্বাঘাসকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, বলতে পারো, আমি আমার মামণির জন্য তাজা ফুল কোথায় পাবো?

দুর্বা বলল, তার জন্য তোমাকে দক্ষিণ দিকে যেতে হবে। সেখানে একদম তাজা হাসনাহেনা ফুল পাবে।
তাই রুতু তখন দুর্বার কাছ থেকে দক্ষিণ দিকটা চিনে নিয়ে সেদিকে উড়তে শুরু করলো। কিছুটা এসে সে একটা হাসনাহেনার গাছ পেল ঠিক, কিন্তু তাতে একটাও ফুল ছিল না। গাছটা বলল, আজকে আমার ফুল ফোটার মতো কুঁড়ি ছিল না ছোট্ট পেঁচার ছানা। তুমি বরং পূর্ব দিকে যাও, সেখানে একটা সাদা গোলাপ গাছ পাবে। কী মিষ্টি দেখতে ফুল তার! 

রুতু তখন সেদিকেই উড়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাদা গোলাপ গাছে কোনো ফুল ছিল না। গাছটা তাকে পরামর্শ দিল, তুমি বরং ওই দিকটায় যাও। সেখানে একটা মধুমঞ্জরির ঝাড় পাবে। প্রচুর মধুমঞ্জরি ফুটে থাকে ওখানে।

রুতু তখন গোলাপের দেখানো দিকে উড়ে গেল। তারপর সেখানে সে সত্যিই একটা মধুমঞ্জরির ঝাড় পেল। কী সুন্দর থোকায় থোকায় ফুল ফুটে আছে! গোলাপি আর সাদা ফুল। কী মিষ্টি ঘ্রাণ তাদের!

রুতু মধুমঞ্জরি গাছকে বলল, তুমি কী আমায় কিছু ফুল দেবে? আমি আমার মামণিকে উপহার দেব।

মধুমঞ্জরি খুশি মনেই ওকে এক থোকা ফুল দিয়ে দিল। রুতু খুব আনন্দে ফুল নিয়ে বাড়ি ফেরার জন্য আকাশে উড়াল দিল।
কিন্তু একী! সে যে পথই চিনতে পারছে না। অনেক চেষ্টা করেও রুতু বাড়ির পথ খুঁজে পেল না। এরপর সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করল। রুতুর কান্না শুনে গাছ, বাতাস- সবাই ওকে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে। তারপর ওর মুখে ঘটনাটা শুনে তাদেরও খুব মন খারাপ হলো। একটা বয়স্ক পাকুড়গাছ বলল, ভেবো না তুমি, তোমার মা নিশ্চয়ই তোমাকে খুঁজতে আসবে। ’

অনেক সময় কেটে গেল। রুতু অনেক দিকে ঘোরাঘুরি করল, কিন্তু সে কিছুতেই বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পেল না। একটা বাতাস বলল, দাঁড়াও, আমি খোঁজ নিয়ে আসি। দেখি, তোমার মাকে বা তোমার বাড়ি খুঁজে পাই কীনা।

তারপর সেই বাতাসটা চলে গেল। অনেকক্ষণ পরও ফিরে এলো না। ভোর যখন হবে হবে ভাব, তখন রুতু দেখল বাতাস ফিরে আসছে, সেই সঙ্গে তার মামণি!

মামণি অনেক কাঁদছে আর চিৎকার করে রুতুকে ডাকছে। রুতু মামণিকে দেখতে পেয়ে উড়ে গিয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মামণিকে তাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি কেন বাসা থেকে বেরুলে রুতুসোনা? আমি না তোমাকে কতবার নিষেধ করেছি, বাসা থেকে বেরুবে না? কেন তুমি এখানে একা একা চলে এসেছ? আমি সারারাত কত জায়গায় তোমাকে খুঁজেছি। তুমি জানো না আমি কত ভয় পেয়েছি আর কত চিন্তা করেছি। আর কক্ষনো কিন্তু এমন করবে না। চলো, বাসায় চলো।

রুতু মামণির কথার উত্তর না দিয়ে অনেক বেশি কাঁদতে শুরু করল। তার কান্না আর থামেই না। মামণি জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে? কেন তুমি কাঁদছ লক্ষ্মীসোনা? আমি তো তোমাকে খুঁজে পেয়েই গেছি। এখন আমরা বাড়িতে ফিরে যাবো।

রুতু তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, আজ তো মা দিবস, তাই আমি তোমাকে উপহার দেওয়ার জন্য ফুল খুঁজতে বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম সব ফুলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে। হাসনাহেনা, গোলাপ- কারো কাছেই ফুল পেলাম না। এরপর মধুমঞ্জরির কাছে এসে ফুল পেলাম, কিন্তু তারপর বাড়ি ফেরার পথ হারিয়ে ফেললাম। এরপর বাসা খুঁজতে খুঁজতে এদিকে-সেদিকে ঘুরতে গিয়ে তো আমি মধুমঞ্জরি ফুলগুলোই কোথায় যেন ফেলে এসেছি। আমি তোমাকে মা দিবসের উপহার দিতে পারলাম না মামণি। রুতু আবার কাঁদতে শুরু করল।

মামণি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর রুতুকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললেন, আমি যে তোমাকে খুঁজে পেয়েছি এটাই আমার সবচেয়ে বড় উপহার রুতু, আমি আর কিছুই চাই না। শুধু কথা দাও, আর কখনোই এমন করবে না তুমি।
রুতু মায়ের কোলে মাথা গুঁজে আস্তে আস্তে বলল, না মামণি, আমি আর কখনোই তোমাকে কষ্ট দেব না। মা দিবসে এই প্রতিজ্ঞাটাই তোমার জন্য আমার উপহার।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১১৩০ ঘণ্টা, মে ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।