ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ মে ২০২৪, ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইচ্ছেঘুড়ি

কাঠবাক্সে মা ।। কিঙ্কর আহ্সান

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৪ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪
কাঠবাক্সে মা ।। কিঙ্কর আহ্সান

১.
তমালের মন খারাপ।
একটা লাল রঙের বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে হোটেলের সামনে।

পেছনে একটা অ্যাম্বুলেন্স। সেটা পো পো আওয়াজ না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তমাল অনেকক্ষণ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়িটা দেখছে। রাস্তায় হাজারো মানুষের ভিড়। তমাল তাদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে, ওই তুমাদের নাম ক্যায়া। ক্যায়া...হুম।

তমাল হিন্দি ভাষার এ বাক্যটি বাবার কাছ থেকে শিখেছে। যখনই জানালার সামনে আসা হয় তখনই ভিনদেশের এই মানুষদের সঙ্গে তাদের ভাষায় কথা বলে দোস্তি পাতানোর চেষ্টা করে সে। কেউই অবশ্য কথার জবাবে বলে না কিছু। একটানা অনেকক্ষণ চিৎকার করে তমাল হোটেলে নিজের ঘরে যায়। গিয়ে দেখে তার ঘরে বসে ছোট মামা কাঁদছে। তমাল কাছে যেতেই মামা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুই আজ সব হারালি। তোর আর কেউ রইল না। কেউ না। মামার কান্নার কারণ তমাল জানে না। তার কান্না খুব বিশ্রী লাগে। সে মামার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়।

বাবাকে সকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে না। কোলকাতায় আসার পর প্রতিদিন তমালকে একটা করে কমিকসের বই কিনে দেন বাবা। আজ দেয়নি। তমালের তাই মন খারাপ হয়ে আসে। প্রতিদিন সকালে সিদ্ধ ডিম আর পাউরুটি খেতে খেতে তাকে টিনটিন পড়তেই হয়। অগ্নিপুত্র, ফ্যান্টম না পড়লে তার খাবারই হজম হয় না। আজ কখন বই নিয়ে আসবে বাবা কে জানে!

বাবা কখনই এসব ভুলে যান না। লক্ষ্মী বাবা একটা। কিন্তু আজ কেন ভুলে গেল তমাল জানে না। সকাল থেকে অবশ্য সবকিছুই ওলটপালট হচ্ছে। কেউ আজ তার ঘুম ভাঙায় নি। সে নিজে নিজেই উঠেছে। ঘুম থেকে উঠে কেউ বিছানার পাশে নাস্তা রেখে যায় নি। এমনকি বাবাটা প্রতিদিনকার মতন হাসপাতালে মাকে দেখতে যাবার আগে তার কপালে চুমু খায় নি। এমন চকচকে একটা সুন্দর দিনে সবাই কেন সব কিছু ভুলে যাচ্ছে তমাল তা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না।

পনের দিনের বেশি হয়ে গেল তমালরা কোলকাতায় এসেছে। একটা লাল রঙের গাড়ি ভাড়া করে বেনাপোল হয়ে আসতে হয়েছে তাদের। পার্ক স্ট্রিটের একটা মাঝারি মানের হোটেলে উঠেছে সবাই। আসার দুই দিন পরেই মাকে ভর্তি করা হয়েছে ‘কোটারি’ হাসপাতালে। মা অসুস্থ। অনেক বড় একটা অসুখ হয়েছে তার। অপারেশন করতে হবে। চিকিৎসার জন্যে আসা হয়েছে কোলকাতায়।

হাসপাতালে মায়ের সাথে তমালের দেখা করবার উপায় নেই। ছোটদের হাসপাতালে যাওয়া নিষেধ। শুধু এখানকার ছুটির দিন রবিবারে তমাল কিছুক্ষণের জন্য মায়ের দেখা পায়। সেদিন মা খুব আদর করেন। বুকের ভেতর তমালের মাথাটা চেঁপে ধরে বসে থাকেন অনেকক্ষণ। এসময় মায়ের চোখ থেকে জল পড়তে থাকে। একটু পর পর জিজ্ঞেস করেন, আমি যদি আর না থাকি তবে বাচ্চাটা আমার ঠিকঠাক থাকবে তো? পড়াশোনা করবে তো? ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া করবে? তমাল মায়ের প্রশ্নগুলো মনযোগ দিয়ে শোনে না। সে প্রতিটা প্রশ্নের জবাবে শুধু, হুম, হু বলে।

আসলে কথা না বলে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে বসে থাকতেই ভালো লাগে। এসময় তার নিজের বাড়িটার জন্য মনটা আনচান করে। ভিসা নিয়ে কি একটা ঝামেলার কারণে বড় বোনকে বাড়িতে রেখে আসতে হয়েছে। তমালের বড় বোনটার কথা মনে পড়ে খুব। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে আসা হয়নি। বন্ধুরা হয়তো তাকে ভুলে গিয়েছে। কতদিন বাড়ির সামনের মাঠে বোমবাস্টিং খেলা হয় না। টিফিনের টাকা জমিয়ে টম অ্যান্ড জেরির পোস্টার কেনা হয় না। হয় না বিকেলবেলা হটপেটিস খাওয়া। লুডু খেলায় হেরে গিয়ে বোনের মাথার চুল ছেড়া হয় না অনেকদিন। বাবা সন্ধ্যেবেলা পড়াতে বসিয়ে বলেন না, তমাল বলতো, শামসুর রাহমান কে ছিলেন? আচ্ছা রম্বস কি? টুইঙ্কল টুইঙ্কল কবিতাটা ঠিকঠাক করে বলতো একদম। মা গরম গরম কুয়ো পিঠা ভেজে নিয়ে এসে বলেন না, নে নে তমাল, ঝটপট খেয়ে নে তো। আর শোন, বেশি মিষ্টি খাস না। দাতের যা অবস্থা!

 

তমালের বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে। সে চায় সবকিছু আগের মতো হোক আবার। এখানে তার কান্না পায়। কিছুই ভালো লাগে না। ভালোর মধ্যে একটু প্রতিদিন বাবা একটা কমিকসের বই কিনে দেয় এই যা!
গতকাল অপারেশন নাকি হয়েছে মায়ের। সুস্থ হলে খুব শিগগিরই বাড়ি ফিরবে তারা। তমাল প্রার্থনা করে মা যেন সুস্থ হয় তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি যেন ফেরা যায় বাড়ি।

হোটেলে ঘরের দরজার সামনে অনেক মানুষের ভীড়। কান্না থেমেছে একটু মামার। একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিবার ফোনে কথা বলার সময় অবশ্য কেঁদে উঠছেন ফুঁপিয়ে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হচ্ছে এখন। তমালের কমিকসের বই আসে নি। কেউ তাকে খাবারও দিয়ে যায় নি। তমালের খিধে পেয়েছে। সে খিধেটা একদম সহ্য করতে পারে না।
হোটেলের দরজা দিয়ে বাইরে এসে তমাল বাবাকে দেখতে পায়। মোটা ফুলো ফুলো দুটো লাল চোখ বাবার। তমালের রাগ হয় বাবাটার ওপর। মায়ের কাছে হাসপাতালে না গিয়ে এই অ্যাম্বুলেন্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকও লাগে। সে ছুটে গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ায়। তারপর বলে, মাকে দেখতে হাসপাতালে যাবে না বাবা। কালতো রবিবার। আমি কি মাকে দেখতে পাবো? প্রশ্ন শুনে তমালের বাবা চুপ থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, তোমার মাকে দেশে নিয়ে যাচ্ছি। আর হাসপাতালে যেতে হবে না। তোমার মা আজ আমাদের সাথে দেশে যাবেন। এখন যাও হোটেলের ভেতর যাও। আজই রওনা দেবো আমরা। মামাকে গিয়ে বলো তোমার কাপড়চোপড় গুছিয়ে ব্যাগে নিতে। যাও।

বাবার কথা শুনে তমাল হোটেলের ভেতর চলে আসে। আজই ফেরা হবে শুনে ভালো লাগে। কিন্তু সে সকালে খায় নি, তাকে কমিকসের বই কিনে দেওয়া হয়নি এসব নিয়ে বাবার কোনো চিন্তাই নেই দেখে রাগটা বাড়ে। সে কাপড় গোছানোর কথা মামাকে না বলে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন এখনও অ্যাম্বুলেন্সের কাছে।



তমালের মনে হয় এই পৃথিবীটা খুব বাজে। খুব পচা। অপারেশন শেষে মা সুস্থ হোক তারপর নালিশ দেওয়া হবে। বাবা, ছোট মামা, বড় বোন, তার কথা জবাব না দেওয়া রাস্তার হাজারো অচেনা মানুষের নামে নালিশ দেওয়া হবে। মা শাস্তি দেবেন সবাইকে। কঠিন শাস্তি। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তমাল তাই প্রার্থনা করতে থাকে, মা ফিরে আসুক। মা ফিরে আসুক। মা  ফিরে আসুক।

২.
দারুণ গতিতে ছুটছে একটা লাল গাড়ি। পেছনে পেছনে পো পো করে আসছে একটা অ্যাম্বুলেন্সও। বাড়ি ফিরছে তমাল। তার মন ভালো হবার কথা। কিন্তু কেন জানি খারাপ লাগছে খুব। মনে পড়ছে মায়ের কথা। কাল রবিবার। মাকে দেখতে পাবার কথা কাল। গাড়িতে বসে মাকে দেখার কথা বাবাকে বলতেই কেঁদে উঠেছে সে। বলেছে মা তাদের সাথেই আছে। আসছে পেছনের গাড়িতেই। একটা কাঠের বাক্সের ভেতর নাকি ঘুমিয়ে। মা কেন পেছনের গাড়িতে থাকবে? কেন বিছানা ছেড়ে কাঠের বাক্সে ঘুমাবে? কেন তাদের সাথে যাচ্ছে না? মা কেন তমালকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলছে না, আমি চলে গেলে ঠিক থাকবি তো তমাল?

চারপাশের অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখে ছোট্ট তমালের এলোমেলো লাগে সব। মন ভার করে সে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। এখন রাত। এদিকের রাস্তায় তমালদের গাড়ির হেডলাইট ছাড়া অন্ধকার আর সব। জানালা দিয়ে দূর দূরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে তমালের ভয় লাগে। অন্ধকারকে ভয় পায় তমাল। বাড়িতে থাকতে রাত হলেই ভূতের ভয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকা হতো। মা তখন তাকে একটার পর একটা সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি, সুচ রাজকন্যার গল্প শোনাত। ভয় কেটে যেত তখন। মা এখন নেই পাশে। তমালের কেন জানি খুব একা লাগে। ছোট্ট বুকটায় কি যেন হয়। গলার কাছে এসে কান্নার মতন আটকে যায় কিছু একটা।
মা কি ফিরে আসবে? অজানা আশংকায় তমাল আচমকা ডাকতে থাকে মা, মা বলে।
এই প্রথম তার কান্না পায়। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর ডুবে থাকা লাল গাড়িটার ভেতর বসে এই প্রথম সে কাঁদে...কাঁদে।

ইচ্ছেঘুড়িতে লেখা পাঠান এই মেইলে: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩২ ঘণ্টা, মে ২১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।