ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

ইচ্ছেঘুড়ি

গিট্টু কিশোর ক্লাব | মিলন রহমান

গল্প / ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৪
গিট্টু কিশোর ক্লাব | মিলন রহমান

নাহ্! গিট্টু দা’র অত্যাচার আর সহ্য করা যায় না। দুপুর দুইটায় প্র্যাক্টিস করতে হবে! কাঠ ফাঁটা রোদের ভর দুপুরে কী করে সম্ভব।

কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে। কেউই বলতে পারবে না— ‘গিট্টু দা তুমি স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছো’।   তন্ত্র-মন্ত্র চলছে।

গিট্টু দা’র স্বৈরতন্ত্র নিয়ে আলোচনা হলেও তার দরাজ দিলের কথা কেউ ভোলে না। গিট্টু দা’র পয়সাতে তাদের ক্লাব চলে। অবশ্য পয়সা না বলে মোটা টাকা বলাই ভালো। অবশ্য এ জন্য ক্লাবের নাম ‘গিট্টু কিশোর ক্লাব’ হয়েছে।

একটু ফ্লাশ ব্যাকে যাই। ‘গিট্টু কিশোর ক্লাব’ নামটা প্রস্তাব করেছিল আকাশ। খুশি হলেও গিট্টু দা মিনমিনে গলায় আপত্তি করেছিল— ‘পাড়ার লোকের দেয়া গিট্টু নামে ক্লাব করবি? তার চেয়ে আমার বাবার রাখা গোলাম আলী নামে দে না!’

গিট্টু দা’র আপত্তি কিভাবে দূর করবে বুঝতে পারছিল না কেউই। মুশকিল আছান করতে এগিয়ে এলো তুষার। নগদে মগজ ধোলাইয়ে ওর জুড়ি নেই। বলল, ‘ধুর দাদা, কী যে বলো না, শেষে তো লোকে ওটাকে গোলাম আলী না বলে গোলমালি ক্লাব বলে চালিয়ে দেবে। আর গিট্টু নামটাতো এখন শুধু নাম না, একটা ইনস্টিটিউট। সে নামে হবে ক্লাব। দশ গাঁয়ের লোক এক নামে চিনবে। ’ কথাটা মনে ধরলো গিট্টু দা’র। লাজুক কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক আছে...। তোরা যখন এতো করে বলছিস!’ এভাবেই ‘গিট্টু কিশোর ক্লাব’র গোড়াপত্তন।

ক্লাবটা এতো সহজে হয়নি। কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আকাশ, তুষার, অমিত, শান্তির মাথায় অনেকদিন ধরে ক্লাবের ভূত ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু কিভাবে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সিদ্ধান্ত পাকা করতে একদিন বিকেলে মিটিংয়ে বসে। বিস্তর আলোচনা হয়। একটা কমিটি করতে হবে, ছোট ক্লাব ঘর হবে। ব্যাট, বল, ফুটবলসহ খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে হবে। দুম করে প্রশ্ন করে বলে বসে অমিত, ‘কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে?’ অমিতের প্রশ্নে সবাই নড়েচড়ে বসে, ‘তাইতো, টাকা আসবে কোত্থেকে!’ উপায়টা আল-আমিন বের করে। গিট্টু দা’কে ধরলে কেমন হয়? গোলাম আলী ওরফে গিট্টু দা’ আমাদের পাড়ারই ছেলে। বড়লোক বাবার একমাত্র ছেলে। সহজ কাজেও গিট্টু বাঁধিয়ে ফেলে বলে পাড়ার ছেলেরা নাম দিয়েছে গিট্টু দা। মাথায় সামান্য গোলমাল আছে। কেউ বলে ‘সাইত্রিশে প্রবলেম’। তবে গিট্টু দা যা ভাবে তাই করে। তাকে ঠিকমত বোঝানো গেলেই কেল্লাফতে।

আল-আমিনের প্রস্তাবে সবাই একমত। যেভাবেই হোক দাদাকে রাজি করাতে হবে। পরিকল্পনামাফিক সন্ধ্যায় গিট্টু দা’কে বেশ করে আলুপুরি আর চা খাইয়ে ক্লাবের কথাটা পাড়া হলো। নাম হবে ‘গিট্টু কিশোর ক্লাব’ আর গিট্টু দা হবে সভাপতি। ‘তোরা যখন এতো করে বলছিস’— বলে লাজুক হাসি হেসে রাজী হয়ে গেল গিট্টু দা। ‘হিপ হিপ হুররে..., থ্রি চিয়ার্স ফর গিট্টু দা, থ্রি চিয়ার্স ফর গিট্টু কিশোর ক্লাব’। স্লোগান তুললো সবাই।

‘গিট্টু কিশোর ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা হলো। গিট্টু দা’র বাড়ির বাইরের একটি ঘরের সামনে সাইনবোর্ড ঝুললো। ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট, উইকেট, বল ইত্যাদি কেনা হলো। সবমিলিয়ে তিনমাসেই ক্লাব জমজমাট। গিট্টু দা’র তত্ত্বাবধানে বেশ খেলাধূলা, আড্ডাবাজি চলছে। মাঝে মধ্যে আলুপুরি, পিঁয়াজি, বেগুনি, আলুচপের উৎসব হয়। স্বাভাবিকভাবেই স্পন্সরের দায়িত্বে থাকেন গিট্টু দা। তুষারই সবসময় উস্কে দেয়, ‘গিট্টু দা, অন্য কাউকে স্পন্সরশিপ দিয়ে তো আর তোমাকে অপমান করতে পারি না!’ হা, হা করে উঠে গিট্টু দা। বলে, ‘না, না তাই কি হয়? আমি রয়েছি কী করতে?’

এভাবে ভালোই চলছিল। কিন্তু গোল বাঁধলো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে। পাশের পাড়ায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হবে, তার এন্ট্রি আহ্বান। গিট্টু দা পত্রিকা নিয়ে ছুটতে ছুটতে এলেন। ‘আমরা এই টুর্নামেন্ট খেলবো। গিট্টু ক্লাবের খেলা দেখে সবার দাঁতে দাঁত লেগে যাবে। ’ এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু এরপরের কথা শুনে আমাদেরই সবার দাঁতে দাঁত লেগে গেল। ‘কাল থেকে দুপুর দুইটায় প্র্যাকটিস হবে’ ঘোষণা করলেন গিট্টু দা।

সাহসে ভর করে শান্তি জিজ্ঞেস করলো, দুপুর দুইটায় কেন গিট্টু দা? বিজ্ঞের হাসি হেসে গিট্টু দা বললেন, ‘তোরা কি মনে করিস, আমি না ভেবে-চিন্তে কথা বলি? ব্যাটা, সন্ধ্যা হয় ৬টায়। এর আগে দুই ঘণ্টা ব্যাটিং, দুই ঘণ্টা বোলিং প্র্যাকটিস করতে হবে। ছয়টার আগে দুই দুই চার ঘণ্টা হিসেব করলে হয় দুইটা। তাই দুইটায় প্র্যাকটিস, কোনো কথা নয়। সবাই চলে আসবি। ’ বলেই যে গতিতে এসেছিল, তার দ্বিগুণ গতিতে চলে গেল গিট্টু দা।

মাঝে মধ্যেই স্বৈরাচারী কায়দায় সিদ্ধান্ত চাপালেও তা গা সওয়া হয়ে গেছে ক্লাব সদস্যদের। কিন্তু এবার গিট্টু দা কী বললো! সবার মাথায় হাত। গিট্টু দা ছয়টা থেকে হিসেব করে এসে দুইটায় গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু তখন যে সূর্য ব্যাটা মাথার চান্দি বরাবর ঠ্যাকে সেটা তো আর গিট্টু দা’র মাথায় আসেনি।

বুঝতেই পারছো ফ্লাশ ব্যাক আর তন্ত্র-মন্ত্রের কারণ। দুপুর দুইটায় প্র্যাকটিসের ঘোষণায় বিদ্রোহ দানা বাঁধতে শুরু করলো। অবশেষে গোপন মিটিং বসলো। সিদ্ধান্ত হলো, ‘পলিটিক্স খাটিয়ে গিট্টু দা’কে জব্দ করতে হবে। কর্ম পরিকল্পনা তৈরি ও দায়িত্ব বণ্টনও হয়ে গেল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী পরদিন সবাই দল বেঁধে গেলাম গিট্টু দা’র কাছে। তুষার কথাটা পাড়লো, ‘গিট্টু দা, তোমার নেতৃত্বে গড়া ক্লাব, অথচ সেখানে গণতন্ত্র নেই। লোকে শুনলে কী বলবে!’ গিট্টু দা’ও দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা ভালো করে বুঝিয়ে বল। তুষার শুরু করল। ‘তুমি আমাদের প্রেসিডেন্ট, তুমিই আমাদের সভাপতি—এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমরা সবাই জানি তুমি ছাড়া ক্লাব ঘরে বাতি জ্বলবে না। তবে নির্বাচনের মাধ্যমে তোমার প্রেসিডেন্টশিপটা বৈধ করতে হবে। না হলে লোকে কান কথা বলে। ’

শান্তি কিছুটি জুড়ে দিলো, ‘কোনো চিন্তা করো না দাদা। আমাদের সব্বার ভোটে তোমার নিরঙ্কুশ বিজয় হবে। ’ আল-আমিন আরেক কাঠি বাড়িয়ে বলল, ‘শতভাগ ভোট গ্রহণ, আর শতভাগ ভোটে তোমার বিজয়। চাই কী তুমি গিনেস বুকেও নাম তুলে ফেলতে পারো!’ গিট্টু দা রাজী হলো। গিনেস বুক বলে কথা, ‘তোরাই যখন ভোট দিবি, তখন আর আপত্তি কী? নির্বাচনের আয়োজন কর। ’ সবাই খুশিতে বাক-বাকুম করতে করতে বাড়ি ফিরলো। গিট্টু দা’ টোপ গিলেছে। এখন শুধু খেল দেখানোর পালা।

নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হলো। গিট্টু দা প্রার্থী। কিন্তু একা একা তো নির্বাচন হয় না। তাই অমিতকে দাঁড় করানো হলো। আগ বাড়িয়ে সবাই গিট্টু দা’কে ভোট দেয়ার কথা বলে মিছিলও করে ফেললো। গিট্টু দা’ও বুঝলেন তাকে বৈধ করতে এই ব্যবস্থা। যথারীতি সভাপতি পদে ভোট গ্রহণ হলো। ফলাফল ঘোষণা করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম। গিট্টু দা’ এক ভোট; বাকি সব ভোট অমিতের নামে। ব্যালট পেপার ফেলে সবাই পালিয়ে বাঁচলো। সবাই গিট্টু দা’কে কথা দিয়েছে তাকে ভোট দেবে। কিন্তু গিট্টু দা’ এক ভোট পাওয়ায় কেউই দাবি করতে পারছে না যে সে তাকে ভোট দিয়েছে! এ নিয়ে বাকিদের মধ্যেও বিবাদ বেঁধে গেল। একে অপরকে দায়ী করতে শুরু করলো, ‘তুই কেনো গিট্টু দা’কে ভোট দিলি না!’ যদিও সবাই গিট্টু দা’কে হারিয়ে জব্দ করতে চেয়েছে। কিন্তু কেউই যদি তাকে ভোট না দেয় তাহলে সে তার নিজের ভোটটাই পাবে—এটা আর কেউ ভেবে দেখেনি। এখন মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

দু’দিন কেটে গেল। ক্লাবটা নিয়ে সবাই চিন্তিত। হঠাৎ কেরামত আলী খবর দিল গিট্টু দা সবাইকে ডেকেছেন। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়ে সবাই হাজির হলো ক্লাব ঘরে। গম্ভীর মুখে গিট্টু দা বললেন, ‘তোরা একটা সত্যি কথা বলেছিলি—আমি ছাড়া ক্লাব ঘরে বাতি জ্বলবে না। দু’দিন আমি ক্লাব ঘরে আসিনি। ঘরের আলোও জ্বলেনি। এজন্য আমি তোদের মাফ করে দিলাম। কিন্তু এবার সত্যি করে বলতো তোরা কেন এমন করলি?’

সবাই গিট্টু দা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘দাদা, মাফ করে দাও। তুমিই আমাদের প্রেসিডেন্ট। ’

গিট্টু দা তার সেই ট্রেডমার্ক লাজুক হাসি হাসলেন। তারপর মোলায়েম সুরে বললেন, ‘দুপুর দুইটায় প্র্যাকটিসের কথা বলেছিলাম। কিন্তু ওসময় যে ভর দুপুর তা আমার মাথায়ই আসেনি। কিন্তু তোরা সেটা ধরেছিস। তবে আরেকটা ভুল তোরা ধরতে পারিসনি। ’ গিট্টু দা যেন বিজয়ের হাসি হাসলো। আমরা সবাই চেপে ধরলাম, ‘সেটা কী দাদা?’

গিট্টু দা বললেন, আমি বলেছিলাম দুই ঘণ্টা বোলিং, দুই ঘণ্টা ব্যাটিং প্র্যাকটিস। তো বোলিংটা না হলে ব্যাটিংটা হবে কী করে? তোরা তো তা বললি না!



বাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।