ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

প্রথম কিস্তি

রিকশা ভূত || রোকন রাইয়ান

গল্প / ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫
রিকশা ভূত || রোকন রাইয়ান

১।
রাত বারোটায় তেঁতুলতলা বাজারে রিকশা পাব এমন ধারণা করাটা কেবল অমূলক নয়, অন্যায়ও।

এই অজপাড়াগাঁয়ে এখনো সেভাবে বিদ্যুৎ আসে নি। কেবল যারা একটু পয়সাওয়ালা তারা নিজ খরচে মাইল দুয়েক দূর থেকে বিদ্যুতের তার টেনে এনেছে। তাই এই এলাকার পথঘাট সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকার হয়ে যায়। কোনো লোকজন থাকে না। রিকশা পাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু আজকে কেন ব্যতিক্রম সেটা কল্পনা করতেই মাথা গুলিয়ে গেল। শেষে নিজের ভাগ্যের সুতো আজ লম্বা মনে করে রিকশাটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

রিকশাওয়ালা সিটের উপর পা তুলে বসে আছে। নিচে বাঁধা হারিকেনটা নিভু নিভু করছে। রিকশাওয়ালার চেহারা দেখে চিনতে পারলাম। উত্তরপাড়ার মনছুর। আমার উপস্থিতি এখনো টের পায়নি। অন্ধকারে নীরব রাস্তায় একা একা তার চোখ বন্ধ করে গুনগুন করার কথা। সে এই কাজই করছে।
আমি হালকা গলা খাকারি দিলাম। রিকশাওয়ালা নড়ে উঠল। রিকশা থেকে নেমে বলল, ‘ওঠেন। ’

আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম তার চোখে কোনো বিকার নেই। এত রাতে আমি এখানে আসব এটা যেন তাকে আগেই বলা হয়েছে। সে যেন আমার কথা জেনেই এখানে অপেক্ষা করছে। লোকটা আমাকে কি চিনতে পারল? চিনবে কিভাবে? সে আমাকে ভালো করে দেখেই নি। কাঁধ থেকে ব্যাগটা হাতে নিয়ে আমি রিকশায় উঠলাম। রাত বেড়ে যাচ্ছে। এত কিছু ভাবার সময় এখন নেই। তাছাড়া আমি সায়েন্সের ছাত্র। ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করার বাতিক থাকার কথা নয়। এইসব অবাস্তব কল্পনার সময়ই বা কোথায়!

রিকশা চলতে শুরু করল। আমি বললাম, ‘কোথায় যাবেন জিজ্ঞেস করলেন না?’
রিকশাওয়ালা নির্বিকার উত্তর দিল, ‘জ্বী, বলেন?’
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘না জেনেই যাওয়া শুরু করলেন যে?’
‘জ্বী, ভুল হয়া গেছে। মাফ করে দেন। ‘ বলল রিকশাওয়ালা।
আমি বললাম, ‘মাফ করব কেন? আপনি তো কোনো অপরাধ করেনি। ’
রিকশাওয়ালা কোনো উত্তর দিল না। গ্রামের মানুষরা হয় বিনয়ী। কথায় কথায় এদের মাফ চাওয়ার অভ্যাস। বিষয়টা মন্দ না।
আমি আবার বললাম, ‘আমি যাবো চকঘাগড়া, সালামের দোকান। চেনেন তো আপনি?’
রিকশাওয়ালা বলল, ‘জ্বী চিনি, শুধু এখানেই না, দেশের সব জায়গাই আমরা চিনি। ’

দেশের সব জায়গা?  প্রশ্নটা মগজে উত্তাপ বাড়ালেও মুখ দিয়ে বের করলাম না। গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো এরকমই। মরিচ কিনলে এরা মাছের গল্প করে।

অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছে রিকশা। চুপচাপ বসে আছি। অমাবস্যায় নিঝুম প্রকৃতি দেখতে বেশ লাগে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। বাতাস নেই। প্রকৃতি ঘুমিয়ে থাকে নীরবে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা নিশিপাখি উড়ে যায়। অন্ধকারে সেটা দেখা যায় ঢিল ছোঁড়ার মতো।

‘ভাইজান কি ঢাকা থেকে আইলেন?’ নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করল রিকশাওয়ালা।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। ’

ঢাকা থেকে এলাম, সেটা কিভাবে বুঝলেন প্রশ্নটা করতে চেয়েও বাদ দিলাম। এত রাতে এলাকায় কেউ আসা মানেই দূর থেকে আসা। আর সেই দূরটা ঢাকাই হবে।

রিকশাওয়ালা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ঢাকার পল্টনে থাকেন?’
‘জ্বী, কীভাবে বুঝলেন বলেন তো?’ এবার আর কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

রিকশাওয়ালা ছোট্ট গলা খাঁকারি দিয়ে দীর্ঘ কথার প্রস্তুতি নিল। তারপর যেন খোলা মাঠে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, ‘পল্টনে আমি গিয়েছি, বায়তুল মোকাররমে নামাজ আদায় করেছি, গুলিস্তান পাতাল মার্কেটে কয়েকবার গিয়েছি, রাস্তার নিচে মার্কেট, উপরে শোঁ শোঁ পোঁ পোঁ করে গাড়ি চলছে, বেশ মজার!’

‘বেশ মজার’ শব্দটা তিনি এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যেন এইমাত্র চুলা থেকে নামানো গরুর কাবাবে কামড় দিলেন। আমি মাথা দোলালাম হালকা করে। যদিও সেটা সামনে বসা রিকশাওয়ালা দেখতে পেল না, কিন্তু ঠোঁট দিয়ে আওয়াজ বের করতে ইচ্ছে করল না।

‘ভাইজান কি ভূতে বিশ্বাস করেন?’  কতক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করল রিকশাওয়ালা।

আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। বললাম, ‘পৃথিবীতে এই একটাই সবচেয়ে বড় ফালতু ভয় চালু আছে। এক সময় বাচ্চাদের গল্প তৈরির জন্য ভূত সৃষ্টি হলেও এখন বড়দের মুখেই বেশি শোনা যায় ভূতের কথা। ’ অজান্তেই তিরস্কারের একটা শব্দ বেরুলো ঠোঁট দিয়ে। সেটা রিকশাওয়ালা টের পেল কিনা বোঝা গেল না।
তার মতো আবার কথা শুরু করল। বলল, ‘ভূতদের কিছু অসম্ভব ক্ষমতা আছে, তারা চাইলেই অদৃশ্য হতে পারে, যে কোনো প্রাণীর রূপ ধারণ করতে পারে। ’

[চলবে]

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।