ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ঘোড়া ভূতের গ্রাম ‍

ইব্রাহিম নোমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
ঘোড়া ভূতের গ্রাম ‍

এক.
রমিজ মিয়ার ছিল নজরকাড়া একটি ঘোড়া ও বিড়াল। তাদের গ্রামে রমিজ মিয়া ছাড়া অন্য কারো ঘোড়া ছিল না।

তাই সবখানে রমিজ মিয়ার একটু বাড়তি কদর। সবসময় রমিজ মিয়ার কোলে থাকত তার আদরের বিড়াল কুট্টুস। রমিজ মিয়া যখন ঘোড়ায় চড়ে পথ চলতেন তখন ছোট বড় সবাই তার দিকে একবার না একবার চোখ ফেলতোই। তবে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘোড়ার পেছন ছাড়তে চাইত না। দৌড়াদৌড়ি ও লাফালাফিতে ঘিরে রাখত ঘোড়াসমেত রমিজ মিয়াকে। ঘোড়ায় চড়েও রমিজ কুট্টুসকে ঠিকই কোলে রাখতেন।

তার বন্ধুরা আফসোস করে অনেক সময় তাকে বলত- রমিজ, তোমার ঘোড়ায় একদিনও কিন্তু চড়তে দিলে না। তাই রমিজ মিয়াও সুযোগ পেলেই তার বন্ধুদের ঘোড়াটিতে চড়াতেন।

দুই.
কয়েকদিন ধরে রমিজ মিয়াদের গ্রামে ভূতের কথা শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যা নামলেই দেখা যায় সাদা আর কালো ডোরাকাটা কি যেন হাঁটছে। আবার কখনও দেখা যায় হাঁটছে না দৌড়াচ্ছে। কিন্তু কেউ সামনা-সামনি দেখেনি। যারা দেখেছে সবাই দূর থেকে দেখেছে। হঠাৎ দেখা যায় আবার বাতাসে মিলিয়ে যায়। তখন দূর থেকে শোনা যায় ঘোড়ার টগবগ টগবগ শব্দ। তাই গ্রামের সবাই নাম দিয়েছেন ঘোড়া ভূত।
সত্যি সত্যিই যে ঘোড়া ভূত নামে একটি ভূত গ্রামে আছে, এ কথা কেউ ঠিকভাবে বলতে পারে না। গ্রামের বড়োদের মুখে শুনেছে ঘোড়া ভূতের কাহিনী। তবে কেউ তা বিশ্বাস করে, আবার কেউ করে না।

রমিজ মিয়াদের গ্রামেই থাকত পল্টু পালোয়ান। পাশের গ্রামে কুস্তি লড়ে সেদিন সে বাড়ি ফিরছিল। কুস্তি জিতে পল্টু পালোয়ান বেজায় খুশি। মনের আনন্দে সে গান গাইতে গাইতে বাড়ি যাচ্ছে আর একটু পরপর সোনার মেডেলটি বের করে দেখছে। কুস্তি জেতার খুশিতে পল্টু ছেলেমেয়ের জন্য বাজার থেকে মাছ কিনে নিল। তবে বাজার থেকে ফিরতে যেন একটু বেশিই রাত হয়ে গেল। রাত হলেও বাজার থেকে ফেরার পথে কোনো না কোনো সঙ্গী জুটে যায়। তবে আজ রাতে রাস্তায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

এমনিই রাত হয়ে গেছে বেশি, তার ওপর আবার গ্রামে আছে ভূতের আনাগোনা। পল্টু পালোয়ানের যেন মনে হল তার পেছন পেছন কেউ হাঁটছে। আস্তে করে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, না পেছনে কেউ নেই। কিন্তু একটু পর আবার শব্দ হল। এবার তিনি যেন ঘোড়ার টগবগ টগবগ শব্দ শুনতে পেলেন। কিন্তু এবারও তিনি কিছুই দেখতে পেলেন না। আবছা অন্ধকার। সব কিছু পুরো দেখা যাচ্ছে না- আবার জমাটবাঁধা অন্ধকারও নয়।

পল্টু পালোয়ান পথ চলতে চলতে যখন প্রধান রাস্তা থেকে তার বাড়ির মেঠো পথে পা বাড়ালেন, তখন হঠাৎ দেখলেন সামনে থেকে একটি ঘোড়া আসছে। তিনি চমকে উঠলেন। পল্টু দেখলেন, ঘোড়ার ওপর রমিজ মিয়া। মনে মনে ভাবলেন, রমিজ ভাই হয়ত দূরে কোথাও গিয়েছিলেন, তাই বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে গেছে। পল্টু বলে উঠলেনÑ রমিজ ভাই কোথা থেকে আসছ? কোনো কথা নেই। আশপাশে সবকিছু নিঝুম। কিছু দূর থেকে একটি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। আর ঘোড়ার টগবগ পায়ের শব্দ।

পল্টু এবার বললেন- রমিজ ভাই, তোমার ঘোড়ায় করে আমাকে একটু বাড়ি পৌঁছে দাও না। পথ চলতে চলতে খুব কাহিল হয়ে পড়ছি। পা যেন আর চলছে না। দাও না রমিজ ভাই তোমার ঘোড়ায় চড়তে। আমি কিন্তু তোমার ঘোড়ায় কখনও চড়িনি। তুমিও ডেকে একদিনও চড়ালে না।

ঠিক এমন সময় ঘোড়া থেমে গেল। রমিজ মিয়া বলল, আচ্ছা, মাছটা আমার হাতে দিয়ে তুমি ঘোড়ায় চড়। পল্টু ঘোড়ার কাছে গেলেন। কিন্তু ঘোড়ার কাছে যেতেই ভয়ে শিউরে উঠলেন। তার গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। এতো রমিজ ভাই নয়, ঘোড়ার ওপর বসে আছে একটা বিড়াল। বিড়ালটা দেখতে ঠিক কুট্টুসের মতো। পল্টু পালোয়ান ভয়ে দিল দৌড়। কিন্তু তার আগেই ঘোড়ার লাথি খেয়ে তিনহাত দূরে ছিটকে পড়ল পল্টু। লাথি পল্টুর মিয়ার পেটে এসে পড়ল। তিনি মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।

তিন.
পরদিন সকালে পল্টুকে অজ্ঞান অবস্থায় পথের পাশে পাওয়া গেল। ধরাধরি করে তাকে বাড়িতে নেওয়া হলো। পল্টুর যখন জ্ঞান ফিরল তখন তিনি রাতের সব ঘটনা অনেক কষ্ট করে বললেন। সবাই পল্টুর কথামত পল্টু যেখানে জ্ঞান হারিয়েছিল, সেখানে গিয়ে মাছ খুঁজলেন। মাছ না পেলেও মাছের কাঁটা ঠিকই পাওয়া গেল। ঠিক দু’দিন পর সকালে পল্টু পালোয়ান মারা গেল। এরপর ঘোড়া ভূতের সঙ্গে সঙ্গে বিড়াল ভূতের কথা নতুন করে সমস্ত গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল।

গ্রাম থেকে গঞ্জ, গঞ্জ থেকে সমস্ত থানার মধ্যে লোকমুখে এ ঘটনাটি ঘুরতে লাগল। এ ঘটনার পর সন্ধ্যা হলেই কেউ আর ঘর থেকে বের হতো না। সাহসী যারা, তারা ঠিকই বের হতো। রাত যখন নিঝুম হতো এবং সবাই ঘুমিয়ে পড়ত তখন ঘোড়ার পায়ের খুরের শব্দ স্পষ্টই শোনা কয়েকদিন পর রমিজ মিয়াকে রাস্তায় অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। ধরাধরি করে তাকে নিজ বাড়িতে নেওয়া হলো। জ্ঞান ফিরলে তিনি সবাইকে বলেন, গতকাল রাতে মাছ খাওয়ার সময় আমি দেখলাম, ঘোড়ার ওপর বিড়াল কুট্টুস বসে আছে আর আমাকে বলছে, মাছটা দে, না হলে পল্টুর মতো তোকেও ঘোড়ার লাথি খেতে হবে।

তখন অমি বললাম,আমি তোমাদের মালিক, আমাকে মাফ কর। আমি মাছ দিচ্ছি। কিন্তু মাছ দেওয়ার পরও কুট্টুসের ইশারায় ঘোড়াটা ঠিকই আমাকে লাথি মারল। আমি দূরে ছিটকে পড়লাম। ঘোড়ায় চড়ে কুট্টুস আমার কাছে এসে বলল, গ্রামের সবাইকে বলবি তোর বাড়ির সামনে একটা পুকুর কাটতে। আর সেই পুকুরে মাছের চাষ করতে। প্রতি শনিবার পুকুরে জেলেদের দিয়ে মাছ উঠিয়ে আমাদের দিতে হবে। তাহলে আমরা গ্রামের কাউকে আর ভয় দেখাবো না। একথা বলেই রমিজ মিয়া মারা গেল।

গ্রামের সবাই মিলে রমিজ মিয়ার বাড়ির জায়গায় একটা পুকুর কেটে তাতে মাছের চাষ করল। তারপর প্রতি শনিবার মাছ উঠিয়ে রমিজ মিয়ার বাড়িতে রেখে দিত। এরপর থেকে বিড়াল ভূত আর ঘোড়া ভূত সত্যিই কাউকে ভয় দেখাতো না। তবে গভীর রাতে শোনা যেত, মিউমিউ আর টগবগ টগবগ শব্দ।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৫
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।