এমন একটা সময় ছিল, যখন আমার বাবা বনজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। নানা পশুপাখির কত কাণ্ড দেখতেন! ওদের বুদ্ধি দেখে বাবা আশ্চর্য হয়ে যেতেন।
একদিন বাবা চন্দ্রনাথের গভীর জঙ্গলে অনেক আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখলেন। সেসব গল্পের কথা তিনি আমাদের বলতেন। আমরা তার সেসব গল্প আগ্রহ নিয়ে শুনতাম।
বাবা জঙ্গলের জীবজন্তুদের ভালোবাসতেন। আর এদের হত্যা করাটা খুব ঘৃণা করতেন। তবে আত্মরক্ষা আর খাবারের প্রয়োজন হলে সেটা ভিন্ন কথা। জীবজন্তুর চলাফেরা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন বাবা। আর তাদের আচরণ বেশ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন। বাবা বলতেন, অনেক প্রাণী মা-বাবা বাচ্চাসহ পরিবারের মতো বসবাস করে। অনেকে আবার দলবন্ধ হয়ে থাকতে পছন্দ করে।
গভীর জঙ্গলে কয়েকদিন ঘোরাঘুরির পর বাবা আর তার সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে এলেন। তারপর তারা খোলামতো একটি জায়গায় জড়ো হলেন। জায়গাটা একটি জলাশয়ের কাছেই।
জলাশয়ের কাছাকাছি জায়গায় কয়েকটি বসতবাড়ি। পাশে একটি সরকারি বাংলোও ছিল। এমন মনোরম জায়গা দেখে বাবা আর তার সঙ্গীরা বেশ আনন্দিত হয়ে উঠলেন। তারা ভাবলো, এবার তারা লোকজনের সঙ্গ পাবেন, আর টাটকা মাছ ও শাকসবজি খেতে পারবেন। সপ্তাহ শেষে তারা আবার জঙ্গলে ফিরে যাবেন। যাওয়ার সময় তারা ডাল, আলু মরিচ সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বাবাও খুব খুশি হয়েছিলেন।
তারা এক সময় বাংলোয় গিয়ে উঠলেন। বাবা একটা বড় আরাম চেয়ারে বসেছিলেন। হঠাৎ করে মনে হলো, কেউ যেন তীক্ষè স্বরে ডাকছে, শব্দটা বোধহয় লম্বা জলাশয়ের দিক থেকে আসছিল।
বাবার এক সঙ্গী, এতক্ষণ যিনি বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলেন, তিনি দৌড়ে এলেন তার কাছে। বললেন, ‘ভাইসাহেব, একটু তাড়াতাড়ি আসুন, দেখে যান কী অদ্ভুত দৃশ্য। ’
বাবা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লেন। জলাশয়ের কাছে গিয়ে লোকটা হাত তুলে নদীর ওপারের একটা বটগাছের দিকে দেখিয়ে দিলেন।
বাবা দেখলেন অদ্ভুত একটা দৃশ্য। বটগাছের ডালগুলোয় অনেক বানর বেশ চুপচাপ বসে আছে। তারা একটা আদেশের অপেক্ষায় যেন। একটা উঁচু ডালে বয়স্ক একটা বানর। অপর বানরগুলোর দিকে মুখ করে আছে সে। আদেশদাতার দৃশ্যটা দেখেই বোঝা গেলো একটি সভা হচ্ছে ওখানে।
বানরগুলো মাঝারি আকারের। লালচে বাদামি রঙের সব বানর। উপরের ডালে বসেছে বয়স্ক বানরটা। তবে তার কিছু কেশ ছাই রঙের। লেজ অর্ধেক নেই। তার কোঁচকানো মুখ দেখে মনে হলো, যেন একটা বয়স্ক জ্ঞানী লোক।
সব বানর বয়স্ক বানরটার দিকে তাকিয়ে আছে। একেবারে নিচের দিকের একটা ডালে ছোট্ট কম বয়সী একটা বানর দল থেকে বেরিয়ে আলাদা হয়ে বসলো। বানরটা হইচই করছিল। দুটো বানর এসে সেটাকে ওদের লম্বা ও পেশিবহুল হাত দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
হঠাৎ বয়স্ক বানরটা আটকানো বানরটির উদ্দেশে কী একটা আদেশ করলো। অপর বানরগুলো নীরবতা ভেঙে শুরু করলো প্রচণ্ড চেঁচামেচি। বন্দি বানরটাকে নিচে নামালো দুটো বানর, যেগুলো ওটাকে ধরে রেখেছিল। তারপর বানর দুটো ছোট বানরটার হাত-পাগুলো চেপে ধরে একটু দোল খাওয়ালো। তারা তাকে দূরে জলের মধ্যে নিক্ষেপ করলো।
কী একটা দাবি জানানোর জন্য সব বানর চেঁচামেচি শুরু করলো একসঙ্গে। তারা সবাই নেমে এলো জলাশয়ের পাড়ে। জলে ফেলা বানরটাকে কেউ সাহায্য করবে না। দেখে মনে হলো, সে তীরে উঠতে পারছে না। সে ভালো সাঁতার কাটতে পারে। সে তীরে ওঠার চেষ্টা করছে আর অন্য বানরগুলো তাকে জলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সে জলের নিচ দিয়ে সাঁতরে উঠতে চাইলো। বারবার চেষ্টা করলো পাড়ে উঠতে। অন্যরা তাকে অনুসরণ করছিল, যাতে সে কূলে উঠতে না পারে। শিগগিরই সব বানর অদৃশ্য হয়ে গেলো ওখান থেকে।
বাবা অবাক হয়ে দেখলেন বানরটা নদীর অপর পাড়ে সাঁতরে ওঠার চেষ্টা করেনি। অথচ সে দিকে কোনো পাহারা নেই। বাবা ভাবলো সম্ভবত বয়স্ক বানরটি ওই দলের নেতা, কম বয়সী বানরটা হয়তো বানরদের আইন অমান্য করেছে। তাই তাকে এ শাস্তি দেওয়া হলো।
ছোট বানরটাকে তারা মেরে ফেলতে চায়নি। বানরটা ডুববে না। কারণ, সে ভালো সাঁতার জানে। তবে সে আর ওই দলে ফিরতে পারবে না। তাকে নির্বাসিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬২৫ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৬
এএ