বাবা আমাদের অনেক বানরের গল্প শুনিয়েছেন। আমি আবার সেগুলো বলতাম বন্ধুদের।
‘বানর অনেকটা মানুষের মতো’, বাবা আমাদের বলতেন।
একদিন গভীর বনে পাখি শিকারে গেছেন। সঙ্গে তার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাদের ভাগ্য ভালো ছিল না। শিকার খুব একটা জোটেনি। ফেরার পথে তারা একটা বানরের দল দেখেছিলেন। বানরগুলো ছোট ছোট আর লাল রঙের। তারা বেশ চেঁচামেচি করছে। এ গাছ থেকে ও গাছে লাফাচ্ছে। পাকা ফল আর পোকামাকড় খুঁজছে।
হঠাৎ লোকজন দেখে তারা জড়ো হয়ে গেলো। নার্ভাস হয়ে গিয়েছিল তারা। বাবার এক বন্ধু খেলার ছলে খালি বন্দুকটি উপরে উঠিয়ে বানরের দিকে তাক করলো।
তৎক্ষণাৎ বানরগুলো হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। হাত দুটো ক্ষমা চাওয়ার মতো করে জোড় করা। চোখের দৃষ্টি করুণ। বাবা তার বন্ধুকে বললো ভালো করে থাকাতে। বন্ধুটি লজ্জা পেয়ে বন্দুক নিচু করল। আর দেরি না করে বানরগুলো উঠে দ্রুত পালিয়ে গেলো।
আমাদের বাবা বানরের অনেক গল্প জানতেন। তিনি আমাদের কালোমুখী বড় বানরের গল্প বলেছিলেন। বানরগুলো খুব চালাক। একবার তিনি কতগুলো বানরকে একটা জলাশয় থেকে বাদাম নেওয়ার ব্যাপারটা দেখেছিলেন। সবচেয়ে বড় আর ভালো বাদাম জন্মেছিল জলাশয়ের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়। সেখানে জলের গভীরতাও ছিল বেশি। বড় বানরগুলোই কেবল মাঝখান থেকে বাদাম নিতে পারে। জলাশয়ের মাঝখানে জল প্রায় তাদের কাঁধ ছুঁয়েছে।
তারা কিছু বাদাম তুললো আর ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খেয়ে ফেললো। হঠাৎ করে কিসের ভয়ে যেন তারা আবার ফিরে এলো। বাবা অবাক হয়ে গেলেন একটা ব্যাপার দেখে। বানরগুলো সবাই মুঠো মুঠো কাদামাটি মাথায় দিলো আর আবার তারা জলাশয়ের মধ্যিখানে চলে গেলো।
তারা একসঙ্গে বাদাম তুলতে লাগলো। বাদামগুলো তারা মাথার কাদায় রাখতে লাগলো চেপে চেপে। এতে বাদামগুলো পড়ে যাচ্ছে না। ইচ্ছেমতো বাদাম নিয়ে তারা ফিরলো।
বাবা তা দেখে বুঝে নিলেন যে বানরদের তো পকেট বা ঝুড়ি নেই। তারা বাদামগুলো কোথায় রাখবে? একসঙ্গে অনেক বাদাম নেওয়ার জন্য তাদের এই বুদ্ধি আঁটা।
কিছু লোক বলে, জন্তু-জানোয়ারদের চিন্তা করার শক্তি নেই। তারা কেবল সহজাত প্রভৃতির উপর নির্ভর করে। বাবার তাই ওটা দেখে বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
বাবা আমাদের এমন আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন।
‘বাবা একবার আমাদের দুই মামাকে নিয়ে উড়িষ্যার ঘন জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েছিলেন। একটা সুন্দর জায়গা পরিষ্কার করে ক্যাম্প ফেলেছেন তারা। ক্যাম্পের চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ।
প্রথমেই তার চোখে পড়লো একটা মৌচাক। মৌচাকটা একটা বটগাছের নিচু ডালে দারুণভাবে ঝুলে আছে। মৌচাকটা মধু এমনভাবে টইটম্বুর হয়ে আছে, মৌচাকের নিচের একটা ছিদ্র দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে। মধু খুব একটা আঠালো নয়। আর রংটাও মৌমাছির মতো সোনালি নয়। কেমন যেন পানির মতো, রংও ফ্যাকাশে। মৌচাক থেকে মধু গড়িয়ে পড়ার কারণ মৌচাকের নিচে একটা ছিদ্র হয়ে গেছে।
হঠাৎ সেখানটায় একটা হনুমানের বাচ্চা তার মায়ের লেজ মুঠো করে ধরে এখানে এলো। বাচ্চাটা খেয়াল করলো মৌচাকের মধু। তার আঙুলে মধুর একটা ফোঁটা পড়লো। মুহূর্তে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তারপর সে মৌচাকের ছিদ্রটায় জিভ লাগিয়ে দিলো।
একফোঁটা মধু হঠাৎ তার জিবে পড়লো। ছোট্ট হনুমানটা ভালো করে মৌচাকের ছিদ্রটা দেখলো, যেটা দিয়ে মধু পড়ছে। সে চেষ্টা করলো ছিদ্রপথে আঙুল ঢোকাতে। হঠাৎ একটা মৌমাছি বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চা হুনুমানটার নাকে হুল ফুটিয়ে দিলো। মা আর বাচ্চা হনুমানটা চিৎকার দিয়ে সেখান থেকে পালালো। বাবা ভেবেছিলেন ব্যাপারটা এখানেই শেষ। কিন্তু না বাবা ভুল বুঝেছিলেন। কিন্তু শিগগিরই তারা ফিরে এল। সঙ্গে নিয়ে এল একটা বড় পুরুষ-হনুমান। মা আর বাচ্চা হনুমানটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়লো। বড় পুরুষ হনুমানটা মৌচাকটার চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখলো বেশ সতর্কতার সঙ্গে।
একটু পর একটা মৌমাছি মৌচাকের ছিদ্রপথে বের হয়ে উড়ছে। হনুমনাটা সেটাকে পাঁচ মিনিট ধরে দেখল। তারপর সে দ্রুত মৌচাকের উপরে গিয়ে হাতের একটা থাবা দিয়ে ছিদ্রবন্ধ করে ধরে রাখলো।
মামার বেশ কৌতূহল হলো। দেখতে চাইলো হনুমানটা কী করে। হনুমানটা আধ ইঞ্চি তার হাতটা সরালো। তারপর নিচের ছোট ছিদ্রটায় অপর হাতের একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিলো। একটা মৌমাছি দু আঙুলে শক্ত করে ধরে বের করে মেরে ফেলে দিলো। পরে সে আরও একটা মৌমাছি ধরে মেরে ফেললো। শেষে হনুমনাটা এলো নেমে।
পরদিন দেখা গেলো মৌচাকটা একেবারে নীরব। মৌচাকের উপরে মাছিগুলো মরে আছে। আর একটা চিকন ধারায় মৌচাকের নিচ দিয়ে মধু পড়ছে। সারাদিন হনুমানটা সেটার নিচে বসে রইলো।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০১৬
এএ