আমরা তখন খুব ছোট। আয়মা নামে এক বয়স্ক নারী আমাদের দেখাশোনা করতেন।
গ্রামটা ছিল উঁচু জায়গায়। বেশ ঠাণ্ডা। অমন উঁচু আর শীতল জায়গায় বানর থাকতো না। তবে গ্রামবাসীদের বেশ বিরক্ত করতো ভালুকেরা। ভালুকগুলো বেশি বড় ছিল না। গায়ের রং ছিল গাঢ় বাদামি। স্বভাবত তারা বেশ শান্ত থাকতো। তবে কেউ বিরক্ত করলে যেতো রেগে।
আয়মা বলেছিল ভালুকগুলো বড় দল বেঁধে থাকতো না। বড়জোর দুটো বা তিনটে একসঙ্গে থাকতো। যেমন মা আর দুটি বাচ্চা। বাচ্চাগুলো বেশ নাদুস-নুদুস। আর বেশ খেলাধুলায় মেতে থাকে। গ্রামের শিশুরাও তাদের সঙ্গে খেলতে চাইতো।
গ্রামবাসীরা কেউ ভালুক পছন্দ করতো না। কারণ ভালুকেরা তাদের খেত আর ফসল নষ্ট করে ফেলতো। সবজি আর ফলমূল চুরি করতো। কখনও খেয়ে ফেলতো, কখনও বা নিয়ে যেতো। তারা চারা উপড়ে ফেলতো শিকড়শুদ্ধ। শিকড় খেতে তারা খুব মজা পেতো। আক্রমণ চালাতো মৌচাকে।
সম্পদ কীভাবে বাঁচাবে গ্রামবাসী সবসময় তা ভাবতো আর যথাসাধ্য চেষ্টা করত। ওখানকার লোকেরা বেশ ব্যস্ত থাকত। এমনকি মহিলারাও বেশ পরিশ্রম করতো। তারা কাঠ থেকে আঠা, রেজিন, পাইন গাছের ফল সংগ্রহ করতো। পুরুষরা বনে কাঠ কাটতো আর বন পাহারা দিতো। সবজি বাগানে বেশ কড়া পাহারা। বাচ্চাদের সবসময় ভালুকের নজর থেকে আড়াল করে রাখতো, কেননা ভালুকের কাছ থেকে বাচ্চাদের তারা নিরাপদ মনে করতো না।
‘ভালুকেরা কী ছোট্ট শিশুদের খেয়ে ফেলত? আয়মাকে জিগ্যেস করেছিলাম আমরা।
আয়মা বলেছিল, না না, তারা শিশুদের খেতো না। তারা শাক সবজি, ফলমূল, গাছের শেকড় এসব কচ কচ করে চিবিয়ে খেতে পছন্দ করতো। বাঁধাকপি খুব পছন্দ। অনেক সময় পাহাড়ের উপর থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলতেও আমার বাবা দেখেছে। পাথরগুলোকে গড়িয়ে দিতো মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে চলা ছোট প্রাণীদের চাপা দেওয়ার জন্য। ভালুকরা শেয়াল আর হায়েনা একদম পছন্দ করতো না। শেয়াল আর হায়েনারা হাঁস-মুরগি এমনকি কুকুরের বাচ্চাও চুরি করে খেতো।
এ ভালুকদের কাছ থেকে মৌচাক রক্ষা করার জন্য গ্রামবাসীরা এক ধরনের ঝুলন্ত গাছের মোটা কাণ্ড ব্যবহার করতো। একটা মোটা গাছের কাণ্ড শক্ত দড়িতে পেঁচিয়ে বেঁধে মৌচাকের উপরে গাছের শাখার সঙ্গে মৌচাকের সামনে একটু নিচু করে ঝুলিয়ে দিতো। এ কারণে ওই গাছের ঝুলন্ত কাণ্ড পেরিয়ে মৌচাকে পৌঁছানো ভালুকদের পক্ষে সম্ভব হতো না। ওটা সরাতে চাইলেও পরমুহূর্তে সেটা এসে ভালুকটার মাথায় বা পিঠে আঘাত করে।
আয়মা একদিন এমনি একটা দুখী মা ভালুকের গল্প করেছিলেন। মা ভালুকটার দুটো বাচ্চা ছিলো। সে বাচ্চা দুটি নিয়ে একটা মৌচাকের কাছে এসেছিলো। সেই মৌচাকে একটা গাছের কাণ্ড বেঁধে রেখেছিলেন আয়মার বাবা। আয়মা ব্যাপারটা দেখছিলেন তাদের ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে।
মা ভালুকটি কাঠটি জোরে ঠেলে দেয় আর সেটা ভালুককে আঘাত করে। এ সময় বেশ রেগে ওঠে মা ভালুকটি। মা ভালুকটি কাণ্ডটা ঠেলে দেয় আর সেটা দোল খেয়ে ফিরে এসে আঘাত করে বাচ্চা ভালুকটার মাথায়। ছোট্ট বাচ্চা বালুকটি এতে বেশ ব্যথা পায়।
এমনটা বেশ কয়েকবার ঘটতে থাকে। তবে দমে না মা ভালুকটি। এক সময় ঝুলন্ত কাণ্ডটার ধাক্কায় বাচ্চা ভালুকটা পড়ে যায়। বেশ ব্যথা পায় ওটি। কয়েক জায়গায় এতে জখম হয়, আর রক্ত বেরিয়ে পড়ে। এরপর মা ভালুকটি ওখান থেকে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায় একটা বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে। যাবার সময় সে আহত বাচ্চাটা ফেলে যায়।
পরে সন্ধ্যার সময় আয়মার বাবা বাচ্চা ভালুকটা ঘরে নিয়ে আসে। তারা সেটার ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেয়। যত্ন করে ওটাকে তারা পালতে থাকে। ভালুকটা তাদের সঙ্গে অনেক বছর কাটায়। এরই মধ্যে সেটা অনেক চাতুরি শিখে ফেলে। মাঝেমধ্যে সেটাকে আয়মার বাবা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। নখগুলোও কেটে পরিষ্কার করে দেয়। যাতে খেলাধুলার সময় কেউ এতে ব্যথা না পায়।
ভালুকটি আয়মার বাবার পিছু পিছু চলে যেত ঠিক একটা পোষা কুকুরের মতো। গ্রামের সবাই তাকে চিনতো। তারা জানত ভালুকটার মন মেজাজ বেশ ভালো আর আননন্দায়ক। তাই গ্রামের কেউ তাকে ভয় পেতো না। সে গ্রামের অন্যান্য লোকেদের ঘরেও যেত দুধ আর মধুর লোভে। আর তারাও ওকে দুধ বা মধু খেতে দিতো।
আয়মার বাবা মারা যাওয়ার পর ভালুকটা জঙ্গলে পালিয়ে যায়। তারা ওটার খোঁজে জঙ্গলে গিয়ে ডাকে নিকো নিকু ফিরে এসো। কিন্তু নিকো আর ফিরে আসে না। এরকম তারা বেশ কিছুদিন খোঁজ করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়।
এরপর যখন আয়মা আর তার বোন জ্বালানি কাঠ কুড়াতে জঙ্গলে গিয়ে তাকে দেখতে পান। ভালুকটা তাদের দেখতে পেয়ে হয়তো বেশ খুশি হয়। তাদের চরিদিকে খুশিতে তিড়িং বিড়িং করে আনন্দে লাফায়। তবে তাদের সঙ্গে ঘরে ফিরে আসে না।
বাংলাদেশ সময়: ১১০৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০১৬
এএ