ছোট্ট ছেলে শিবু। সেই কবে থেকে নববর্ষের আশায় বসে আছে।
আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই চমকে উঠলো শিবু। কি ব্যাপার! সবাই এরকম সাজ-গোজ করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে কেন? কিছুই বুঝতে পারলো না ও। পিছন থেকে মা এগিয়ে এসে করে বললো, শুভ নববর্ষ শিবু।
শিবুর চোখ কপালে উঠে গেলো! তার মানে আজই সেই নববর্ষের দিন। কিন্তু এই ক’টা দিন তো কেউই তাকে কিছু বলেনি। তার মানে এটা তার জন্য একটা সারপ্রাইজ! মনের আনন্দ আর ধরে রাখতে না পেরে মাকে অমনি জড়িয়ে ধরলো শিবু। খুশির বন্যায় ভাসতে লাগলো সবাই।
কিছুক্ষণ পরেই শিবু তার বৈশাখী ড্রেস পরে দাদুর সঙ্গে সোজা বৈশাখী মেলায় চলে এলো। মেলার সেকি আয়োজন! না দেখলে যেন বিশ্বাসই করা কঠিন। চারদিকে কেবল কোলাহল আর কোলাহল। জাঁকজমকপূর্ণ মেলার হরেক রঙের জিনিস দেখেতো কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
অবশেষে দাদু নিজেই পছন্দ করে খেলনা বাঁশি, খেলনা বন্দুক, টমটম গাড়ি আরও কত কিছু যে কিনে দিয়েছিল তা বলে শেষ করার নয়। মেলার এক প্রান্তে নাগরদোলা দেখে চমকে উঠেছিল শিবু। তারপর আর কোনো কথা নেই। সোজা দাদুর কাছে আবদার করে বসলো নাগরদোলায় চড়বে। কথা শুনে দাদু একটু হেসে কোমল হাতের একটা আঙুল ধরে নিয়ে গেলেন নাগরদোলার কাছে। তারপর তাকে নাগরদোলায় চড়িয়ে দিলেন।
নাগরদোলা যখন উপর থেকে নিচের দিকে নামে তখন শিবুর বুকে কেমন যেন ধড়াৎ করে ওঠে। নিচে থেকে দাদু তখন সাহস জুগিয়ে দেয় তাকে। শিবু নাগরদোলার দোল খেতে খেতে একবার চোখ চলে গেলো মেলার এক কোণায় বটগাছের তলে। সে দেখে একটা ছোট্ট ছেলে কাঁদছে আর কাঁদছে। মন আর মানলো না শিবুর। আজ এমন আনন্দের দিনেও ছেলেটা কাঁদছে কেন? না, এ বিষয়টা তাকে দেখতেই হবে! নাগরদোলা অনেকক্ষণ দুলতে দুলতে যখন দোলা শেষ হলো তখন শিবু হুট করে দাদুর কাছের এসে বললো, দাদু, চলো না ওই বটগাছের কাছে যাই।
কেন দাদুভাই? ওখানে গিয়ে কি হবে?
ওখানে একটা ছেলেকে দেখলাম কাঁদছে। চল না ওকে গিয়ে সাহায্য করি।
শিবুর কথার দাদু আর না করতে পারলো না। সোজা বটগাছের তলায় ছেলেটার দিকে ছুটে গেলো।
কি ব্যাপার তুমি কাঁদছ কেন? তোমার কি হয়েছে? বললো শিবু।
আমার নাম রতন। আমার মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ভুল করে আমি মায়ের হাত ছেড়ে দিয়ে বেলুন দেখতে চলে গিয়েছিলাম ওখানে। তারপর...’
মেলায় এসে এ কাজগুলো করা উচিত নয়। এমন কাজ আর কখনও কোরো না। দাঁড়াও একটা ব্যবস্থা করছি।
শিবু তার দাদুকে বললো, দাদু, চলো আমরা ওর মাকে খুঁজে বের করি।
মেলার ভেতর শতশত মানুষ। ওর মাকে খুঁজে বের করা কিভাবে সম্ভব দাদুভাই?
কেন, ওই যে মাইক দিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করছে যে লোকটা তার কাছেই গিয়ে বলবো, একটু মাইক দিয়ে জোরে করে ঘোষণা দিন দিন যে রতন এই বটগাছের তলায় বসে আছে। রতনের মা আপনি কোথায়? তাহলেই হবে। তখন দেখবে রতনের মা ঠিক চলে আসবে বটগাছের সামনে।
শিবুর কথা শুনে দাদু তো অবাক। এতটুকু একটা ছেলের মাথার ভেতর এত্ত বুদ্ধি! শিবুকে বলল, ‘চল তাহলে জলদি যাই।
শিবুর কথার মতোই আইসক্রিমওয়ালা লোকটার কাছে গিয়ে একটু অনুরোধে সবকিছু বুঝিয়ে বলে তারপর মাইক হাতে নিয়ে জোরে জোরে রতনের মাকে ডাক দিতে লাগলো। মাত্র দুই মিনিটও যায়নি তার মধ্যেই বটগাছের তলায় এসে হাজির হয়ে গেলো রতনের মা। তারপর যা হওয়ার তাই! রতনকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে সুখের কান্না কাঁদতে লাগলো রতনের মা।
আকাশ বাতাসে সুখের বন্যায় ভাসতে লাগলো। শিবুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কোনো ভাষা পেলো না রতনের মা। শুধু প্রাণ ভরে দোয়া করলো শিবুর জন্য। সৃষ্টিকর্তার প্রতি শিবুর অনেকদিন বেঁচে থাকার কামনা করে সেই রতনকে বুকের ভেতর আগলে ধরে সেই স্থান ত্যাগ করলো রতনের মা।
শিবুও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। বাড়ি ফেরার সময় দাদু একবার শিবুকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাতর কণ্ঠে বললেন, নববর্ষের দিনে এমন একটা ভালো কাজ নিজের চোখে দেখতে পেরে আমার মতো শান্তি বোধহয় পৃথিবীর আর কেউই পায়নি। তোর জন্য আমার আজ গর্ব হচ্ছেরে শিবু!
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৬
এএ