সন্ধ্যেবেলা পাপাই নিজের ঘরে বিছনায় বসে পড়ছিলো। তীব্র গরম বলে আম্মু সব জানালা খুলে দিয়েছে।
পাপাই খাতা বের করে লিখতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ বাদেই সিলিং ফ্যানে ট্যাং.. শব্দ হলো। থপ করে পাপাইয়ের খাতার সাদা বুকে ডানা পেতে পড়লো কালো প্রজাপতিটা। ওমা একি হলো! পাপাই পেন্সিল দিয়ে প্রজাপতির গায়ে হালকা টোকা দিলো, একটুখানি পা নাড়িয়ে আর নড়লো না প্রজাপতিটা। পাপাই এবার হাত দিয়ে স্পর্শ করলো তার পাখা। আঙুলের রেখাগুলো একটু ঝিকিমিকি দিলো পাপাইয়ের। খুব কাছ থেকে পাপাই দেখলো প্রজাপতিটাকে, আগে কখনও এতো কাছ থেকে এভাবে দেখেনি।
ছোট্ট পাপাই বুঝলো প্রজাপতিটা আর বেঁচে নেই, মরে গেছে। এখন সে কী করবে? ফেলে দেবে জানালা দিয়ে? নাকি তুলে ময়লার ঝুড়িতে রাখবে? কিন্তু মরদেহ ফেলতে আছে? না না বড্ড অন্যায়। পাপাই ভাবলো, প্রজাপতির মরদেহকে মাটির নিচে রেখে আসতে হবে। পাপাই তাড়াতাড়ি খাতাসহ প্রজাপতিটাকে খাটের নিচে রেখে চপ্পল পরে বাড়ির উঠানে গেলো। সারাটা উঠান খুঁজে ঠিক করলো হাসনাহেনা গাছের নিচে প্রজাপতির কবর দেবে। ঘরে এসে প্রজাপতিটাকে পরম যত্নে হাতে তুলে হাসনাহেনা গাছের কাছে নিয়ে এলো। মাটিতে ছোট্ট একটা গর্ত করে কালো প্রজাপতিটাকে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দিলো। প্রজাপতির কবরের উপর ছড়িয়ে দিয়ে কিছু হাসনাহেনা ফুল।
সেদিন রাতে পড়াশোনা শেষে খেয়ে-দেয়ে পাপাই শুয়ে পড়লো। আম্মু এসে লাইট অফ করে দরজা টেনে নিজের ঘরে চলে গেলেন। পাপাই বারান্দার দেয়ালে রেখাটানা আলোর ছায়া মুছে যেতে দেখে বুঝলো আম্মুও লাইট অফ করে দিয়েছেন। চারদিক চুপচাপ। ফ্যানে ট্যাং করে একটা শব্দ হলো। পাপাই কাঁথা ফেলে উঠে বসলো, কী ব্যাপার? আরেকটা প্রজাপতি বাড়ি খেয়ে পড়লো নাকি? সে উঠে ঘরের লাইট জ্বালালো।
- বাতিটা নিভিয়ে দাও প্লিজ!
- কে? পাপাই ভয় পেয়ে বললো।
- আগে নেভাও, তারপর বলছি।
পাপাই বাতি নিভিয়ে দ্রুত খাটে এসে কাঁথা জড়িয়ে বসলো। তখনই একটু দূরত্বে তার চোখের সামনে জ্বলে-নেভে তারার মতো স্বচ্ছ রুপালি দুটো ডানা দেখতে পেলো। অনেকক্ষণ দপদপে ডানার দিকে তাকিয়ে থেকে পাপাইয়ের মাথা ঝিম দিয়ে উঠলো।
তার মুখ দিয়ে ক্ষীণস্বরে বেরিয়ে এলো – আম্মু, ভূত!
- না না, আমি সুজুকি।
- কে তুমি?
- আমি কালো প্রজাপতি সুজুকি।
- মানে?
- আমি কয়েক ঘণ্টা আগে তোমার ফ্যানের আঘাতে মরে গিয়েছিলাম। তুমি আমায় হাসনাহেনার নিচে কবর দিয়ে এসেছো।
- তুমি তাহলে কালো প্রজাপতিটার আত্মা?
- হুম, তাও ভালো ভূত না বলে আত্মা বললে। তুমি বেশ দয়ালু। অন্য কেউ হলে আমাকে মরা অবস্থায় পেলে হয় ডানা ছিঁড়তো, পিষে ফেলতো আর নয়তো ময়লার ঝুঁড়িতে ফেলতো। তুমি খুব ভালো পাপাই।
- তুমি আমার নাম জানো কী করে?
- ওই যে আমি মরে যাওয়ার পর তুমি আমার ডানায় স্পর্শ করেছো তা থেকেই জানি।
- তোমার কষ্ট হয়নি সুজুকি? ব্যথা পেয়েছো খুব না?
- হুম তা পেয়েছি। মরে গেছি দেখো না? তবে তুমি আমাকে যেখানে কবর দিয়েছো জায়গাটা আমার খুব প্রিয়। আমি ওখানে কত সময় পার করতাম!
- তাই?
- হুম, আচ্ছা শোনো তুমি যখনই কোনো সমস্যায় পড়বে আমাকে ডাকবে। আমি সব সমস্যার সমাধান করে দেবো। একবার ডাকলেই আর সমস্যায় পড়বে না।
- তাই নাকি? কী করে হবে?
- সমস্যার সমাধান তুমিই করবে কিন্তু আমি তোমাকে পথ বলে দেবো। কিন্তু কীভাবে তা বলা যাবে না। বললে আমার আর ক্ষমতা থাকবে না।
- আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমি তোমাকে পাবো কোথায়?
- রাতে লাইট অফ করে ঘুমানোর সময় দেখতে পাবে!
- বুঝলাম না সুজুকি।
- মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে দেখতে পাচ্ছো? যেখানে আমি শেষবারের মতো বসেছিলাম, সেখানে তাকালেই আমাকে দেখতে পাবে। আমার দিকে তাকিয়ে সুজুকি বলে ডাকলেই অামি নেমে আসবো।
- আচ্ছা।
- ঠিক আছে এখন ঘুমাও, কাল ভোরে তোমার স্কুল অাছে না?
- আচ্ছা সুজুকি। গুড নাইট।
একথা বলে পাপাই কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। খানিকক্ষণ ঘুমালোও সে, হঠাৎ তন্দ্রা কেটে গেলে পাপাইয়ের চোখ পড়লো ফ্যানের দিকে। দেখলো সুজুকির রূপালি ছায়া। ডানা পেতে ঠিক সেভাবেই বসে আছে ঘুরতে থাকা ফ্যানের পাশে, যেভাবে শেষবার সে বসেছিলো জীবিত অবস্থায়। নিজের অজান্তে পাপাইয়ের মুখ থেকে বের হলো তিনটি অক্ষর- সুজুকি!
তক্ষুণি ফ্যানে ট্যাং করে বাড়ি লেগে সুজুকির রূপালি ছায়াটা মেঝেতে পড়ে গেলো। পাপাই হন্তদন্ত হয়ে খাট থেকে নেমে সুজুকির ছায়া স্পর্শ করলো। কিছু টের পাওয়ার আগেই ঝাপটে ঝাপটে সুজুকির রূপালি দুটো ডানা শত শত কণায় বিভক্ত হয়ে পাপাইয়ের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। রূপালি কণা আস্তে আস্তে মিহি হয়ে মিশে গেলো তার সারা দেহে। নরম গলায় কেউ বলে উঠলো - পাপাই, আজ থেকে যেকোনো সমস্যায় বন্ধু হিসেবে আমাকে পাবে, সমস্যার সমাধান তুমিই করবে কিন্তু আমি পাশে থাকবো, তোমায় শান্ত রাখবো।
পাপাইর শরীর-মন নিমিষেই তরতাজা হয়ে উঠলো। সে মনের আনন্দে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৫ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৬
এএ