ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

তিন্নিদের ঈদ আনন্দ | সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২০
তিন্নিদের ঈদ আনন্দ | সুমাইয়া বরকতউল্লাহ্

আমাদের বাড়ির তিনটা বাড়ি পরেই তিন্নিদের বাড়ি। তিন্নি খুব ছোট্ট একটা মেয়ে। ভাঙা ভাঙা কথা বলতে পারে। তার বাবা থাকে বিদেশে।

তার বাবা থাকে বিদেশে। ঈদের দু’দিন আগের রাতে, তার বাবার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসার কথা।

সবারই আনন্দ। কিন্তু তিন্নির আনন্দ ছিল অন্যরকম। আমরা বাড়ি গিয়েছি শুনেই তিন্নি এক দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে। হাতে তার বাবার একটা পুরনো ছবি। সে আমার সামনে এসেই আমার মুখটা টেনে নিয়ে বললো, এই যে আমাল বাবাল চবি। এই যে চুক, এই যে নাক, এই যে বাবাল কান, এই যে চুল, আমাল বাবা খুপ সুন্দল। এই যে বাবা হাসে হি হি। ’

আমি বললাম, তোমার বাবা আসলেই খুব সুন্দর। তোমার বাবা ঈদ করতে আসবে না তোমার কাছে?

সে চোখ বড় করে বলল, ‘আমাল বাবা আততেতে। আমাল বাবা উলুজাজে আততে। আমাল বাবা ঈদ নিয়ে আততে। আমাল লাল ফলক আনবে, ডুটা আনবে, মুজা আনবে, চিলুনি আনবে আল মজা আনবে। ’

আমি বললাম, তুমি কী খাওয়াবে তোমার বাবাকে?

তিন্নি কিছু না বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল তার বাড়ি। এই ছোট মেয়ে বাবার জন্য যে আয়োজন করে রেখেছে, তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। সে তার মাকে বলে নতুন ফরাশের চাদর আর বালিশ পেতেছে খাটে। বালিশের ওপর সে রেখে দিয়েছে একটি ফুলের তোয়ালে। বাবার পুরনো জুতো মুছে রেখেছে খাটের তলে। বালিশের পাশেই সে তার বাবার জন্য সবচেয়ে দামি প্লেট, গ্লাস মুছে রেখে দিয়েছে। আমরা যখন খাটে বসতে গেলাম সে বসতে দিল না। ‘আমাল বাবাল খাট, বাবাল চাদল নত্ত হবে তো’ বলে ঠেলতে ঠেলতে আমাদের দূরে সরিয়ে দিল।

তিন্নির মা অনেকটা রাগ করেই বলল, ‘কী করি কও তো। এই বাবাপাগল মাইয়া লইয়া বড় বিপদের মধ্যে আছি। সারাদিন বাবা-বাবা করে। ছবি লইয়া ঘুরে, যারে দেখে তার কাছেই বাবা আসার কথা কয়। কতক্ষণ তা ভাল লাগে, কও তো?’

তিন্নির বাবার ফোন এলো রাতে। কাঁদতে কাঁদতে জানাল, একটা সমস্যা হয়ে গেছে, ঈদের আগে দেশে আসতে পারবে না। তার এই ফোন পেয়ে তো তিন্নির মা কান্নাকাটি করতে লাগল। আন্টিরা গেল দৌড়ে। তিন্নির মা বারবার বলছে, ‘এখন আমি মাইয়ারে কী কমু কন। এই মাইয়ারে তো আমি মানাইতে পারতাম না। মাইয়াডাতো কানতে কানতে শেষ অইয়া যাবে। মাইয়া যদি জানে তার বাবা আসবে না, কী অবস্থাটা হবে কন। আমার মাথায় কিচ্ছু ধরে না। ’

সবাই বুঝিয়ে তিন্নির মাকে শান্ত করেছে। কিন্তু তিন্নিকে কী বলে সান্তনা দেবে, কেউ বুঝতে পারছে না।

ঈদের আগের রাতে তিন্নি তার বাবার অপেক্ষায় থেকে আর ঘুমায় না। অনেক রাতে ঘুমাল। ঘুমের মাঝেও সে নাকি বাবার সঙ্গে কথা বলে। ঈদের দিন সকালে সবাই যখন ঈদ করছে, তিন্নি তখন তার বাবার ছবিটা নিয়ে একা একা কথা বলছে। তার মা তিন্নির দিকে তাকিয়ে গোপনে চোখের পানি ফেলে।

তার মা অনেক চেষ্টা করেও তিন্নিকে গোসল করাতে পারেনি, কাপড় পরাতে পারেনি। আমাদের কাছে এসে বলল তিন্নিকে গোসল করিয়ে, কাপড় পরিয়ে দিতে। গেলাম। বললাম, তিন্নি আপুনি, চলো চলো গোসল করিয়ে দেই, নতুন জামা পরিয়ে দেই, আজ না ঈদ।

তিন্নি দু’হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, ‘না, না, একন ঈদ না। আমাল বাবা ঈদ নিয়ে আতবে। আমি বাবাল থাতে ঈদ কলবো। যাও। ’

এই দিকে একটু পরে পরে তিন্নির বাবা ফোন করে কাঁদে আর তিন্নির খবর নেয়। তিন্নির বাবাও কিছু খায়নি। খালি আফসোস করে। তিন্নির হাতে ফোন দেয়নি। বাবার জন্য তিন্নির নানা আয়োজনের কথা আগেই বলেছিল বাবাকে। এসব মনে করে তার বাবা খালি কাঁদে।

ঈদের দিন। সারাদেশের মানুষ আনন্দ আর হই চই করছে। তিন্নি বসে আছে তার বাবার অপেক্ষায়।

কিন্তু হঠাৎ তার অপেক্ষার শেষ হলো।  বলা নেই কওয়া নেই তিন্নির বাবা এসে হাজির। সবার আনন্দের সঙ্গে তিন্নির আনন্দ একাকার হয়ে মহা আনন্দের বান ছুটেছে তিন্নিদের ঘরে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৮ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।