আজ চুপি চুপি উঠে ছোটনকে না জানিয়ে সেহরী সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে ছোট্টি। কাফেলারা চলে যাবার পরও লেপের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে ছোটন।
ঈদের এক সপ্তাহ আগে বাবার স্বর্ণের দোকানের সারা বছরের ঝাড়ু দেয়া ধূলি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যেত তাতেই ছোটনদের পাঁচ ভাই-বোনের ঈদের কেনাকাটা হয়ে যেত।
ছোটনের স্কুলগেটের শিউলিফুল ছিল ছোট্টির খুব প্রিয়। ছোটন সঙ্গ না দিলে ছোট্টির কপালে সে ফুল জুটতোই না। সেহরী সেরে বাবা মসজিদে উদ্দেশে বেরিয়ে গেলেই ছোট্টি জেগে উঠে বলতো--ছোটন, ছোটন, আই ছোটন, ওঠ্ ওঠ্, আজ খুব দেরি হয়ে গেছে সোনা ভাই আমার। আজ নিশ্চয় সদ্যসুবাসছড়ানো শিশিরভেজা নরম ফুলগুলো আর আমাদের কপালে নেই। দেখিস এতক্ষণে অন্যরা এসে ফুলগুলো কুড়িয়ে নিয়ে গেছে।
ছোট্টি মন ভারি করে বসে থাকলে নোটন জানতে চাইলে ছোটন বলে--আর বলিস না। ওপাড়ায় যে বড়মা আছে না, সেখানে বুবুর জামা বানাতে দিয়েছে, দুবার গিয়ে ঘুরে আসছি। একবার বলেছে ফলস লাগানো হয়নি, আরেকবার বলেছে বোতামঘর সেলাই করা হয়নি, তাই আপা রেগে বসে আছে।
নোটন একদৌড়ে গিয়ে শপিং ব্যাগগুলো বের করে এনে বলে, ছোটন দেখি তুই কেমন প্যান্ট-শার্ট কিনেছিস? ছোটন কিছুতেই ঈদের কাপড়গুলো বের করতে চায় না। বলে, ঈদের আগে এসব দেখালে মজাই তো শেষ। চল আমরা তারচে’ বড়আপার জামা বানাতে দেওয়া ওপাড়ায় দর্জিবাড়িতে যাই, দেখি জামাটার কাজ শেষ হয়েছে কি-না?
নোটন ছোটনের ফুপাতো ভাই, ওরা প্রায় সমবয়সী। এবার নোটন বাবা মার সাথে চট্টগ্রাম থেকে নানাবাড়িতে ঈদ করতে এসেছে। দুজনেই আজ রোজা রেখেছে। দুজনকে বেশ কয়েকবার ছোট্টি বলেছে--এই তোরা সত্যি করে বল, লুকিয়ে লুকিয়ে কিচ্ছু খাসনি তো? মিথ্যা বলিস না, রোজা রেখে মিথ্যা বলতে নেই। ছোটন মাথা দুলিয়ে না-সম্মতি জানায়, সাথে সাথে নোটনও। দু’জনের মলীন মুখ দেখে ছোট্টির মনটাও মায়ায় ভরে ওঠে। শুকিয়ে যাওয়া দুটো শিশুর মুখের দিকে তাকানো যায় না। তবুও যেন তাদের চোখেমুখে আনন্দের কমতি নেই। আপা বলে--এই তো আর মাত্র দু’ঘণ্টা, তারপরই আমরা ইফতার করবো। কাল ঈদ, কি মজা হবে, তাই না নোটন?
ইফতার শেষে সন্ধ্যায় আকাশে যে চাঁদটা দেখা যাবে সেটাই তো সাওয়াল মাসের প্রথম চাঁদ, মানে ঈদের চাঁদ। নোটন আর ছোটন ইফতার শেষ করেই স্কুলমাঠে ছোটে। পিছু পিছু ছোট্টিও। হাত উঁচিয়ে কেউ কেউ দেখাতে চেষ্টা করে ঐ-যে তালগাছের ফাঁক দিয়ে অস্ফুট দেখা যাচ্ছে। চাঁদটাকে একপলক দেখেই দু’জনে আবার ভোঁ-দৌড়। চারদিকে আতোশবাজির শব্দে গ্রামটা আনন্দে কেঁপে কেঁপে ওঠে। আর ক্লাবঘরের মাইক থেকে ভেসে আসে-- ‘ও মন রমজানেরই ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ। ’