আব্দুল মাজেদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বঙ্গবন্ধুর পলাতক অন্য খুনিদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। সেই সূত্র ধরেই বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি রিসালদার মোসলেহউদ্দিনকে আটক করেছে ভারতীয় গোয়েন্দারা।
ভারতীয় পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মোসলেহউদ্দিনকে দেশের কোনো এক স্থলবন্দর দিয়ে ঢাকার কাছে হস্তান্তরও করেছে ভারত সরকার। যদিও সরকারিভাবে এখনও দুই দেশ বিষয়টি স্বীকার করেনি।
কলকাতার সংবাদমাধ্যমগুলোর কেউ দাবি করছে, মোসলেহউদ্দিনকে সীমান্ত পার করে বাংলাদেশ সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। আবার কোনো সংবাদমাধ্যমের দাবি, তিনি এখনো ভারতেই আছেন। তার সমস্ত নথি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশে। সেখান থেকে সবুজ সংকেত এলেই ভারত তুলে দেবে বাংলাদেশের সরকারের হাতে।
প্রকৃত ঘটনা যাই ঘটুক, সংবাদমাধ্যমগুলো একটি বিষয়ে একমত যে মোসলেহউদ্দিন আত্মগোপন করে ছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার যশোরের একটি স্থানে। আর সেসব সংবাদমাধ্যমের ওপর সূত্র ধরে বাংলানিউজ পৌঁছায় যশোর রোড সংলগ্ন ঠাকুরনগড়ে। শহর কলকাতা থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে। যদিও বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে দূরত্ব মাত্র ২৫ থেকে ৩০ মিনিটের। অর্থাৎ মোসলেহউদ্দিন আত্মগোপনের জন্য এমন একটি স্থান নির্বাচন করেছিলেন যাতে প্রয়োজনে সহজেই বাংলাদেশ যাওয়া যায় আবার অঞ্চলটি বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও থাকে। একইসঙ্গে কলকাতার প্রশাসনের চোখ যেন সহজে এড়িয়ে থাকা যায়। বাড়িটির নাম মঞ্জু কুঠির। একেবারে নির্জন একতলা বাড়ি। দেখে কারো সন্দেহ করার মতো কিছু নেই বাড়িটিতে।
জায়গাটি ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের মধ্যে এবং তা গাইঘাটা থানার অন্তর্গত। এলাকাটি মূলত হিন্দু অধ্যুষিত। আর এই এলাকায় মোসলেহউদ্দিন নাম পরিবর্তন করে হয়েছিলেন সমীর কুমার দত্ত।
আরও পড়ুন>>>একটি ব্যাগ হাতছাড়া করতেন না খুনি মাজেদ
যেমনটা বেডফোর্ড লেনে বিহারি মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে আব্দুল মাজেদ হয়ে গিয়েছিলেন আলী আহমেদ। সেই নামেই তৈরি হয়েছিল ভারতীয় নাগরিকত্বের সমস্ত নথি। আর মোসলেহউদ্দিন ধর্ম বদলে হন সমীর কুমার দত্ত। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ইউনানি চিকিৎসা। এটি আয়ুর্বেদ চিকিৎসারাই একটি ধারা। সমীর কুমার দত্ত ‘দত্ত ডাক্তার’ নামে পরিচিত ছিল এলাকায়। শিমুলপুরের যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন তিনি।
ঘটনার সূত্রপাত প্রায় ৪০ বছর আগে। সমীর কুমার দত্তর সঙ্গে দমদমে পরিচয় হয় পরেশ চন্দ্র অধিকারীর। অভুক্ত বেকারের মতো দমদম স্টেশনে পড়ে থাকতেন সমীর দত্ত। অপরদিকে ইউনানি চিকিৎসক ছিলেন পরেশ চন্দ্র অধিকারী। তার হয়েই পথে পথে পোস্টার লাগাতেন সমীর দত্ত। ধীরে আলাপ জমে ওঠে দু’জনের। তৈরি হয় মৈত্রীর সম্পর্ক।
এই অধিকারীর হাত ধরে ঠাকুরনগরে আশ্রয় পান সমীর দত্ত। অবশ্য তখনও অধিকারী পরিবারে পাকাপাকি আশ্রয় হয়নি তার। তবে প্রায়ই আসতেন পরেশ অধিকারীর বাসায়। শিখতে শুরু করে চিকিৎসা পদ্ধতি। এরপর ২০০৯ সালে মারা যান অমল অধিকারী। তখন পাকাপাকিভাবে সমীর দত্ত বসবাস করতে শুরু করলেন অধিকারী পরিবারের সঙ্গে। এমনকী বংশ পরম্পরার চিকিৎসা পুরোপুরি সমীর দত্তের দখলে চলে যায়।
‘অধিকারী ইউনানী চিকিৎসা’ পরিচয় পেতে থাকে ‘দত্ত ডাক্তার’ নামে। এমনই সব তথ্য দিচ্ছিলেন অধিকারীর ছোট মেয়ে মমতা অধিকারী। তার দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন ‘দত্ত জেঠ্যু’। বাবার বন্ধু বলে পরিবারে কোনোদিন আপত্তি করেনি কেউই। তবে মাঝেমধ্যে কোথায় উধাও হয়ে যেতেন আবার কিছুদিন বাদে আসতেন।
আরও পড়ুন>>>১৯ বছর কলকাতার যে বাড়িতে ছিলেন খুনি মাজেদ
তিনি শুনেছেন এই সমীর কুমার দত্তের আসল বাড়ি বাংলাদেশে। তবে কোনোদিন কোনো পরিবার ছিল বলে তাদের জানা নেই- এমটাই দাবি মমতা আইচ অধিকারী ও তার জামাই বিশ্বজিৎ আইচের।
এতদিন সবই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু বাধ সাধে সংবাদমাধ্যমে ওই বাড়ির ‘দত্ত ডাক্তার’ নিয়ে খবর প্রকাশ হতেই। মফস্বল, তাই রাতারাতি প্রচার হতেও সময় লাগেনি। এরপরই ১৯ এপ্রিল রাতে অধিকারী বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। মোড় নেয় গল্পের আর এক দিক। পুলিশ জানতে পারে চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি মারা গেছেন সমীর কুমার দত্ত।
এরপরই মোবাইলে মোসলেহউদ্দিনের ছবি দেখিয়ে গাইঘাটার পুলিশ জানতে চায় একে চেনে কিনা পরেশের মেয়ে-জামাই। তৎক্ষণাত না বলে দিলে বাড়ি থেকে সমীর কুমার দত্তের ছবি মোবাইলে তুলে নেয় পুলিশ। বাজেয়াপ্ত করে তার ডেথ সার্টিফিকেট, আধার কার্ড, ভোটার কার্ডসহ একাধিক নথি।
পরদিন সকালে গোয়েন্দা বাহিনী নিয়ে আবার হানা দেয় পুলিশ। এবার পরপর আরও কয়েকটি ছবি দেখাতে থাকে তাদের। তার একটি ছবি হুবহু মিলে যায় খুনি মোসলেহউদ্দিনের সঙ্গে। এমটাই মত মেয়ে-জামাইয়ের। এরপরই পুলিশ প্রবেশ করে সমীর দত্তের ঘর লাগোয়া চেম্বারে।
কিন্তু চিকিৎসার চেম্বারে নেই চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো বই। তার বদলে আছে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ‘কেনো ভাগ হলো ভারত-বাংলাদেশ’, ‘হিন্দু মুসলমানের বিরোধ’, ‘দিস ইস জিহাদ’, ‘ইসলামের ভারত অভিযান’ ‘ইসলাম কোরান ’, ‘গণতন্ত্র ধর্ম ও রাজনীতি’, ‘ভারত বিভাজন’, ‘বঙ্গভঙ্গ ও রবীন্দ্রনাথ’। এছাড়া কলকাতা থেকে বাংলায় প্রকাশিত চেতন ভগতের লেখা ‘হোয়াট ইংয় ইন্ডিয়া ওয়ান্টস’ ‘যুক্তিবাদীর চোখে নবী মুহাম্মদ’, এছাড়া কয়েকটি মুসলিম ধর্মের বইসহ আরও কয়েকটি বই। বইগুলি বাজেয়াপ্ত এবং বাড়িটির নির্দিষ্ট ঘর ও চিকিৎসার চেম্বারে তালা দেয় পুলিশ।
সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে অনেক অনেক বছর ধরে এই অঞ্চলে আত্মগোপন করে আছেন মোসলেহউদ্দিন। ঠিক কতগুলো বছর এখানে ছিলেন এলাকার মানুষ সঠিকভাবেও বলতে পারছেন না। অনেকের মতে বেশি দিন নয় আবার অনেকে মতে দীর্ঘ বছর এই বাড়িতে যাতায়াত ছিল তার। তবে লোকটি যদি মুসলমানও হয়ে থাকে তাকে কোনোদিন মসজিদে যেতে দেখেনি কেউই। আসলে সমীর দত্তই কি মোসলেহউদ্দিন? প্রশাসন স্পষ্ট না করা পর্যন্ত কাটছে না এ ধোঁয়াশা।
কেন ৪০ বছর ধরে সমীর দত্তের সঙ্গে পরিচয় থাকলেও মৃত পরেশ চন্দ্র অধিকারী ছাড়া তার সম্বন্ধে কেউই বিশেষ কিছু জানেন না? অথচ ২০০৯ সাল থেকে পাকাপাকিভাবে ওই বাড়িতেই বাস করতেন সমীর দত্ত। মাঝে মধ্যে ও অনেকদিন ধরে কেন উধাও হয়ে যেতেন সমীর দত্ত জানেন না তারা? বাংলাদেশে বাড়ি জানে অথচ এর বাইরে কেন একটিও তথ্য তাদের কাছে অজানা? একই উঠোনে একই ঘরের মধ্যে বাস করছে অথচ সমীর দত্তের ঘরে এরকম বই রয়েছে কেন জানতো না অধিকারী পরিবার? ওই পরিবারের সঙ্গে থাকলেও কেন কন্ট্রিবিউট করতেন না? তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর বা পাসবই কোথায় জানা নেই কারো। এরকম আরও প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে এই পরিবার ঘিরে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৩, ২০২০
ভিএস/এএ/এজে