মুরগাব (কুয়েত): কুয়েতে ভালো আছেন প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। ব্যবসা যত ছোটই হোক প্রায় প্রত্যেকের রয়েছে নামি দামি গাড়ি।
সদ্য বাজারে আসা নিত্য নতুন মডেলের কেবল একটিই নয়, অনেকের আছে একাধিক গাড়ি। কারো কারো এ সংখ্যাটি ডজনও ছাড়িয়ে গেছে।
আমাদের দেশে সংসদ সদস্যদের নামিদামি গাড়ি জোটে এমপি হবার সুবাদে। এখানে তা না। রাস্তায় নামলেই দেখা যায়, নিত্যনতুন গাড়ি। ঝা চকচকে এসব গাড়ি হাঁকিয়ে চলা স্বদেশি দেখলেই গর্বে ভরে যায় বুক।
মরুভূমির এই দেশে উন্নত যাতায়াত ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ইউরোপ আমরিকার আদলে। সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। রাস্তায় কোথায় নেই পুলিশ কিংবা ট্রাফিক পুলিশ। সবই পর্যবেক্ষণ করা হয় হাইটেক ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায়। ট্রাফিক আইন ভেঙে আগে যাওয়া কিংবা উচ্চ শব্দে হর্ণ বাজিয়ে শব্দ দূষণ দেখা যাবে না এখানে।
সিগন্যাল পড়ছে। সাথে সাথেই থেমে যাচ্ছে যানবাহন।
কুয়েতের ফাহাহিলের সফল ব্যবসায়ী খুলনার মনিরুল ইসলাম মারুফ (৩১)। বয়সে একেবারে তরুণ। বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি এখনো। তবে সঙ্গী হিসেবে তার রয়েছে নতুন মডেলের ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো। ইতোমধ্যেই পোশাকের মতো বদলেছেন একাধিক গাড়ি।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, এখানে গাড়ি অনেক সস্তা। রেজিস্ট্রেশন ফি নাম মাত্র। আমাদের দেশের মতো দুই থেকে তিনশ’ভাগ মূল্য সংযোজন কর বা ট্যাক্সের কোন বালাই নেই এখানে। আর দেশটিতে কোন রিকন্ডিশনড গাড়িও আমদানি করা হয় না। ফলে প্রতিযোগিতামূলক দামেই উন্নত বিশ্বের নিত্য নতুন মডেলের গাড়ি আমরা খুব অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারি এখানে।
যার একটি খাবারের হোটেল আছে, প্রবাসী সেই ভাইটিও কিন্তু দামি একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। হতে পারে সেটি হয়তো আমার সদ্য বিক্রি করা গাড়ি। কিন্তু প্রবাসী সাধারণ ব্যবসায়ী বা চাকুরিজীবীরা যে ধরনের গাড়ি এখানে কেনেন আমাদের দেশে তা ব্যবহার করেন অভিজাত শ্রেণির লোকেরা। যোগ করেন মনিরুল ইসলাম মারুফ।
তাহলে দেশে গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেন কিভাবে?
খুবই কষ্ট হয়। সর্বশেষ খুলনায় যাবার অভিজ্ঞতা ছিলো বেশ কষ্টের। দীর্ঘ যানজট। গাড়ির এসি নষ্ট। ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাট। কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম।
এখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঢাকায় নেমে হোটেলে প্রয়োজনে এক রাত থেকে পরের দিন অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ধরে যশোর থেকে খুলনায় যাবো। ওইটুকু জার্নি হয়তো সহ্য করা যাবে।
গাড়ি কেনা আর চড়ার ব্যাপারে বেশ ‘চুজি’ সহিদ ইসলাম পাপুল (৪৮)। বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার রায়পুরের এই সন্তান কুয়েতে খ্যাতনামা ‘মারাফি কুয়েতিয়া’ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও।
তার ব্যবসায়িক বহরেই গাড়ি রয়েছে ১২’শ। এ ছাড়াও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও ঢাকার যে কোন খ্যাতনামা গাড়ির শো-রুম থেকে কম নয়।
তার নিজের বহরের রয়েছে রোলস রয়েসের বেন্টলি, বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ, পোরশে, ক্যারেরা ফোর নাইন ওয়ান ওয়ান, ল্যান্ড ক্রুজার, প্রাডো পিজিরো, জিএমসি, নিশান, টয়োটা ক্যামেরি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের নানা মডেলের গাড়ি।
বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গাড়ি আমাদের ফ্যাশন না। বরং ব্যবসার অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। আমরা ব্যবসা করি আমেরিকান মিলিটারিসহ বহুজাতিক বিভিন্ন কোম্পানির সাথে।
যখন তারা কুয়েতে আসেন তখন তাদের স্বাগত জানাতে হয় নামিদামি গাড়ি নিয়েই। তার মাধ্যমেই তারা আমাদের অবস্থান সম্পর্কে প্রাথমিক একটি ধারণা পেয়ে যান।
বলতে পারেন ব্যবসার গতির প্রশ্নেও নিত্যমডেলের গাড়িগুলো আমাদের ব্যবসার সমৃদ্ধিতে নতুন মাত্রা যোগ করে।
অ্যাম্বাসেডর গ্রুপ অব কোম্পানিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মুকাই আলী ওরফে লুৎফর রহমান। তার ব্যক্তিগত গাড়ির বহরের গাড়ির সংখ্যা এক ডজনের বেশি।
সকালে একটি তো সন্ধ্যায় পার্টি কিংবা কোন ব্যবসায়িক মিটিং এ আরেকটি।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, এখানে গাড়ি কোন বিলাসিতা না। প্রয়োজন। তবে আমার অবস্থান আর সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে গাড়ি যে আলাদা মাপকাঠি তৈরি করে দেয় তা কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না।
এখানে নতুন গাড়ি কেনা ও চড়া নিয়ে প্রবাসী ব্যবসায়ীদের মধ্যেই দেখা গেছে এক ধরনের প্রতিযোগিতা। গাড়ি আসক্তি বা নতুন গাড়ির চলাচলে কুয়েত নগরীর ঝা চকচকে রাস্তাঘাটকে এনে দেয় স্বতন্ত্র পরিচয়।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাদুরতলা চক বাজারের হাজি ফয়েজ আহমেদের ছেলে জাফর আহমেদ চৌধুরী। কুয়েতের জনপ্রিয় গুলশান হোটেলের মালিক। তিনি-ও চালান দামি গাড়ি।
বাংলানিউজকে তিনি জানান, ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি চালাচ্ছি। এটা ভাবতেই নিজেকে দেশের এমপিদের মতো মনে হয়। তারা ওদেশে এমপি হিসেবে ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি চালান। আর আমরা প্রবাসীরা এখানেও চালাই ট্যাক্স ফ্রি আধুনিক গাড়ি। তখন দেশের বিবেচনায় নিজেদের এমপি’র মর্যাদা ও সুবিধে পাবার মতো এক ধরনের আনন্দ অনুভূতি কাজ করে। যোগ করেন জাফর আহমেদ চৌধুরী।
এখানকার আমির থেকে শীর্ষ ধনী পরিবারের সদস্যদের রয়েছে এক ধরনের গাড়ি বিলাসিতা।
শক্তিশালী হাইব্রিড-মডিফায়েড ৩.৮ লিটার টুইন টার্বো ইঞ্জিনের গাড়ি ল্যাম্বোরগিনি ভেনেনো, লাইকান হাইপার স্পোর্ট, বুগাটি ভেয়রন সুপার স্পোর্টস, অ্যাস্টন মার্টিন ওয়ান-৭৭, পিজো জোন্ডা সিংক রোডস্টার, জেনোভো এসটি ১, ল্যাম্বোরগিনি রেভেন্টন, কোয়েনিগসেগ আগেরা আর, মেব্যাক ল্যান্ডুলেট, ম্যাকলারেন পি ১, পিজো হুয়েরা, হেনেসে ভেনম জিটি স্পাইডার প্রভৃতি মডেলের গাড়ি হরহামেশাই চলাচল করতে দেখা যায় মরুভূমির বুকে।
খুব শিগগির বাংলাদেশি প্রবাসীদের বহরে বিশ্বের সবচাইতে নামিদামি গাড়িগুলো যুক্ত হবে এই কথা নিঃসন্দেহে বলে দেয় বর্তমানে প্রবাসীদের গাড়ি প্রীতির চিত্র।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৫
আরআই
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!