কুয়েত থেকে: ‘এ খতা যেততে মনত হরে আঁততে আর বাংলাদেশে যাইতাম মনে ন হ’- দেশ নিয়ে এমনই চাপা অভিমান রয়েছে চট্টগ্রামের সন্তান সৈয়দ মোহাম্মদ সেলিমের (৫৭)। তার প্রতি দেশের কিছু মানুষের অমানবিক আচরণের কথা মনে পড়লে বিষন্নতা আর দুর্বলতায় ঢেকে যায় মন।
তারপরও তার কাছে দেশ মানে তো মা। সেই মাতৃভূমির টানেই দেশে যান। সেটা কেবলই মানুষের কল্যাণে। তার কারণেই দেশের অনেকে আজ অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী। কেউ বড় হাসপাতালের মালিক। কেউ বা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আর তিনি নিজে মরুভূমির ধনী রাষ্ট্র তেলসমৃদ্ধ কুয়েতের ধণাঢ্য ব্যবসায়ী। দেশটির শীর্ষ অবকাঠামো নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বাহার আল খালিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কুয়েতের প্রবাসীসহ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তাকে সমীহ করেন। যেকোনো পরামর্শের জন্যে ছুটে যান তার কাছে।
তবে নীরবে থাকাটাই মোহাম্মদ সেলিমের বেশি পছন্দের। প্রচারের আলোয় আসতে চাননি কখনো। জনকল্যাণে থাকেন সবার আগে, তবে আড়ালে। কমিউনিটির কল্যাণে বা কারো সাহায্যের প্রয়োজনে সবার আগে উচ্চারিত হয় তার নাম। কারো বিপদ দেখলেও এগিয়ে আসেন সবার আগে। কাজ আর জনকল্যাণ নিয়েই যতো ব্যস্ততা তাই তার।
সাধাসিধে, ছিমছাম জীবন তার। বিনয় আর দ্রুত মানুষকে আপন করে নেওয়ায় প্রবাসীদের কাছে তার তুলনা তিনি নিজেই।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গহিরা গ্রামের খান বাড়ির ছেলে সৈয়দ মোহাম্মদ সেলিম। বাবা মরহুম সৈয়দ আলী খান। মেরিন একাডেমি থেকে ১৯৭৬ সালে নেভিগেশন নটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক কনটেইনারবাহী বনু-বে নামক মার্চেন্ট শিপে।
ক্যাডেট অফিসার পদ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু মোহাম্মদ সেলিমের। নীল সাগর আর মহাসাগরে ভেসে ভেসে নিজের মেধা আর দক্ষতায় পৌঁছে যান চিফ কমিউনিকেশন অফিসারের পদে। ততোদিনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনকার্ডধারী। নিউইয়র্ক সমুদ্রবন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছেন। ব্রুকলিনের রাস্তায় একদিন প্রাত:ভ্রমণে দেখা হয় বন্ধু আবেদ জাবেরের সঙ্গে। তার পীড়াপীড়িতে চলে আসেন কুয়েতে। যুক্ত হন পাওয়ার স্টেশন নির্মান প্রকল্পে।
সেখানেই সহকর্মী হিসেবে ফিলিপিনো নাগরিক প্রকৌশলী লিয়া কাস্টিলোর সঙ্গে পরিচয় সেলিমের। বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। সময়টা ১৯৮৬ সাল।
এরপর মেধা আর পরিশ্রমে নিজেকে অবকাঠামো নির্মাণ শিল্পে তুলে আনেন অনন্য যোগ্যতায়। সেলিমের হাত ধরেই কুয়েতে বিলিয়ন বিলিয়র ডলারের বেশ কিছু বিশালাকার বিদ্যুত প্রকল্প তৈরি হয়।
রিয়েল এস্টেট সেক্টরের মাধ্যমে আধুনিক কুয়েত বিনির্মাণেও তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সফলতার ধারাবাহিকতায় পরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি সৈয়দ মোহাম্মদ সেলিমকে। নিজেই নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে দেশে-বিদেশে করেন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
১৯৯৪ সালে কানাডার নাগরিকত্ব লাভ করেন সেলিম। খবর এলো, বাবা অসুস্থ। স্ত্রী, সন্তান ও তাদের পরিচারিকাদের নিয়ে ছুটে গেলেন অসুস্থ বাবার শয্যাপাশে। বাবা যেন তার অপেক্ষায় ছিলেন। শেষবারের মতো দেখা দিয়ে বাবা চিরতরে চলে গেলেন। শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ।
এরপরের ঘটনা সেলিমের বর্ণনায়, ‘হঠাৎ শোকের বাড়িতে পুলিশ এলো। ভিনদেশি স্ত্রী ফিলিপিনো নাগরিক প্রকৌশলী লিয়া কাস্টিলো কেন তার পাসপোর্ট নিয়ে থানায় রিপোর্ট করেননি- এ অজুহাতে আমাদের পাসপোর্ট কেড়ে নিলো পুলিশ। আমার স্ত্রী হতবিহ্বল, শঙ্কিত, আতঙ্কিত। পরে জেনেছি, কিছু মানুষের মিথ্যা অভিযোগে পুলিশ এ অন্যায় আচরণ করে আমাদের সঙ্গে’।
সেলিম আরও বললেন, ‘দেশের মানুষের এ আচরণে খুব ছোট হলাম স্ত্রী ও তার পরিচারিকার কাছে। বন্ধু বর্তমানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ তখন মন্ত্রী। তাকে ঘটনাটি বললাম। শুনে মর্মাহত হলেন তিনি। তার নির্দেশে পরে অবশ্য পুলিশ পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু আমার ভিনদেশি স্ত্রীর মন ভেঙ্গে গেলো’।
‘ততোদিনে দেশের ব্যাংকে ১০ কোটি টাকাসহ বিভিন্ন সেক্টরে আমার বিনিয়োগ গড়ে উঠেছে। দেশেই আরো বড় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু ওই ঘটনায় ভেস্তে গেলো আমাদের সেই বিনিয়োগ পরিকল্পনা’।
‘এ খতা যেততে মনত হরে আঁততে আর বাংলাদেশে যাইতাম মনে ন হ’(এ কথা যখন মনে পড়ে আমার বাংলাদেশে যেতে মন চায় না)- মন্তব্য মোহাম্মদ সেলিমের।
সেলিম বাংলানিউজকে আরও বলেন, ‘টরেন্টো-দুবাইয়ে রয়েছে আমার কোম্পানির বিনিয়োগ। তবে দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে মন কাঁদে। নিয়মিত সভায় যোগ দিতে পারি না বলে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালকের পদ ছাড়তে হয়েছে। আমার বন্ধুরাই দেশে আমার ব্যবসা দেখাশোনা করেন। সেখানকার আয় দিয়ে দেশে স্কুল চালাই। এখান থেকেও টাকা পাঠাই দেশে’।
‘ভাবি, সেদিন ওই পুলিশ অফিসার স্ত্রীর সামনে পাসপোর্ট কেড়ে না নিলে হয়তো বাংলাদেশে আমার বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ থাকতো। আমার দেশ সম্পর্কে ভুল ধারণাও থাকতো না কাস্টিলোর। ভিনদেশি অতিথি হিসেবে দেশের মাটি ও মানুষের মুগ্ধতার পরশেও আবদ্ধ থাকতেন আমার স্ত্রী। ইতিহাস অন্যরকম হতো’।
তবে তাদের জীবনের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, তার মুখোমুখি যেন অন্য কাউকে হতে না হয়- এমন প্রত্যাশা সৈয়দ মোহাম্মদ সেলিমের।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৫
জেডআর/এএসআর
** ব্যাডা মাছ, বেডি মাছ!
** ‘ধরা পড়লে রক্ষা নেই, কুয়েত থাকার সুযোগ নেই’
** কুয়েতে একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ বাংলা মার্কেট
** কুয়েতের রাজধানী
** সবার উপর দেশ
** কুয়েতে সবাই এমপি!
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!