ওয়াফরা (কুয়েত) থেকে: হুররর... হুররর...। এভাবেই মুখে শব্দ তুলে মরুভূমির বুকে ছুটছিলেন আদম আলী (৪৮)।
মরুভূমির উষ্ণ মাটিতে পড়ার আগেই শব্দগুলো যে বাজ হিসেবে পড়ছে দুম্বাগুলোর কানে, তা বুঝতে সময়ও লাগে না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দুম্বাগুলো যেন ‘যাদুকরের ইশারায়’ সারি বেঁধে একত্র হলো।
সুবোধ বালকের মতো ঢুকে গেলো খোয়াড়ে। তবে এর মধ্যে অবাধ্য বা বেয়াড়া দুম্বা যে দুয়েকটা নেই, তা কিন্তু না। তাদের নিয়েই যতো দৌড়ঝাঁপ আদম আলীদের। আদম আলীর মতো আরও অনেক বাংলাদেশিদের দেখা মিললো এই মরুর বুকে।
কুয়েত সিটি থেকে সীমান্তবর্তী ওয়াফরা এলাকায় যাবার পথেই বিস্তির্ণ এলাকাজুড়ে কেবলই ধু ধু মরুভূমি। তার বুকেই এমন অসংখ্য দুম্বার খামার। যেখানে কাজ করছেন হাজারো বাংলাদেশি।
মাথার ওপর প্রখর সূর্যের তাপ। পায়ের নিচে তপ্ত মরুভূমি। দূরের কিছু কাঁটা জাতীয় গাছ বাদ দিলে চোখের সামনে কেবলই ধু ধু প্রান্তর। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উষ্ণতা আর শীতে হাড় হিম করা তীব্র ঠাণ্ডা।
এখানে এই পরিবেশেই কেউ ছয় মাস, কেউবা কাজ করছেন ১৫ বছর। কথা হয় আদম আলীর সঙ্গে। দু’মাস পরই কুয়েতে অভিবাসী শ্রমিক জীবনের ১৫ বছর কেটে যাবে তার। এসেছিলেন ২০ দিনার (কেডব্লিউডি) (৫ হাজার ১৪২ টাকা) বেতনের শ্রমিক হিসেবে। এখন তার বেতন ১’শ ২০ দিনার। কষ্টের তুলনায় এই পারিশ্রমিক খুব বেশি না। বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৩০ হাজার।
দিনরাত দুম্বার পালের সাথে থাকতে থাকতে নিজেই একরকম ‘দুম্বায়’ পরিণত করেছেন তিনি। প্রায় সর্বক্ষণ হুররর... শব্দ। ভিন্ন বাচনভঙ্গি আর শব্দ চয়ন করতে হয় তাকে। যার মাধ্যমে দুম্বারা তার ভাষা বুঝতে পারে। যে নির্দেশনা দেন, তা পালন করে- এমনটিই দাবি আদম আলীর।
প্রখর রৌদে পুড়ে গেছে চেহারা। মরুর রুক্ষতা গ্রাস করেছে তার দেহমন। ক্লান্ত চেহারার আদম আলীর সামনে তখন বাংলানিউজের পরিচয়। ‘স্বদেশি সাংবাদিক’ জানা মাত্রই চোখেমুখে সজিবতার ছাপ। বেশ আন্তরিকতা নিয়ে কথা বললেন বাংলানিউজের সঙ্গে।
জানালেন, একজন কুয়েতি মালিকের অধীনে তারা কাজ করেন। এই মালিকের ব্যবসাই হচ্ছে দুম্বা কেনা আর বেচা। মাঝের সময়টা লালন পালন আর পরিচর্যা করাই তার মতো বাংলাদেশিদের কাজ।
এখানকার কাজে এতো কষ্ট যে অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা এ ধরনের কাজ করতেই চায় না।
কারণ একইভাবে দীর্ঘ সময় মরুর তপ্ত বালুতে কাটাতে হয় তাদের। অনেকটা বন্দি বা নির্বাসিত জীবনের মতোই কাটছে এসব শ্রমিকদের জীবন- যোগ করলেন আদম আলী।
আদম আলীর সাথে কথার ফাঁকে এগিয়ে আসেন ঝালকাঠির জাকির হোসেন। তিনিও কাজ করেন এখানে। কুয়েতে এসেছেন সবে ছয় মাস হলো। শুরু থেকেই কাজ করছেন দুম্বার খামারে। বেতন মাত্র ৭০ কুয়েতি দিনার। বাংলাদেশি মুদ্রা সাড়ে ১৭ হাজার টাকা।
বাংলানিউজকে তিনি জানালেন, প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা ব্যয়ে তিনি এখানে এসেছেন। এসেই বুঝে গেছেন, ফেরার পথ আর নেই। দেশে ফিরলে কি করে ধারদেনা শোধ করবেন?- এই চিন্তায় অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই পরিশ্রমের কাজ করতে হচ্ছে তাকে। তপ্ত মরুভূমির আশেপাশে কোনো লোকালয় না থাকায় বাড়তি শ্রম বিক্রির সুবাদে অতিরিক্ত অর্থ আয়েরও সুযোগ নেই জাকিরদের।
এদিকে, কুয়েতে বাড়তি শ্রম বিক্রি করাও অবৈধ। যে কাজের জন্য তিনি নিবন্ধিত, ঠিক সেই কাজ ছাড়া অন্য কোথাও কর্মরত থাকলেও রেহাই নেই। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে সরাসরি জেল। পরে জেলখাটা আসামির পরিচয়ে চিরতরে ছাড়তে হয় কুয়েত।
জাকির জানান, অভিবাসন ব্যয় তুলতেই তাকে প্রায় ১৬ মাস বিনা বেতনে খাটতে হবে। এটা মনে করলেই কষ্টে বুক ভেঙ্গে আসে। চোখ ভেঙ্গে আসা অশ্রু ফোটার মূল্য নেই এখানে। মরুভূমিতে পড়ার মতোই শুকিয়ে যায়। কেউ বোঝে না তাদের কান্না।
এখানকার দুম্বার খামারে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা জানালেন, কুয়েতি মালিকরা দুম্বাসহ বাংলাদেশি শ্রমিকদের এই মরুভূমির বুকে রেখে যায়। মাঝে মাঝে তারা এসে খোঁজ নেয় সব ঠিক আছে কিনা।
দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় হেঁটে সেখান থেকে লোকালয়ে যাওয়াও খুব কষ্টকর। বলতে গেলে প্রায় অসাধ্য। সপ্তাহের নির্দিষ্ট সময়ে কুয়েতি মালিক বা তাদের প্রতিনিধিরা দামি গাড়ি হাঁকিয়ে আসেন দুম্বার খামারে। দুম্বাগুলোর প্রয়োজনীয় খাবার আর পানীয় সরবরাহ করেন। এই দিয়েই চলতে হয় এখানকার শ্রমিকদের।
শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থাও অনেকটা চলন্ত আবাসের মতোই। অস্থায়ী খামারগুলোর পাশে বেশ কয়েকটি ক্যারাভ্যান। যেসব ভ্যানই যেন আস্ত এক একটি চলন্ত বাড়ি। একটি গাড়ির পেছনে এই ক্যারাভ্যানগুলোকে বেঁধে টেনে আনা হয় মরুভূমির বুকে। সেখানেই রাত কাটে বাংলাদেশি শ্রমিকদের।
এতো কাজ থাকতে মরুভূমির কাজ কেন? বাংলানিউজের এমন প্রশ্নে আদম আলী বললেন, ভাইরে ইচ্ছা করে কি আর কেউ কষ্ট করে। তবে এখানে সুবিধাটা হলো মালিক থাকার সাথে খাবার খরচটাও দেয়। তাই মাসের যা উপার্জন, নিজের সামান্য খরচ শেষে অবশিষ্ট টাকা বাড়ি পাঠানো যায়।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ নিয়ে এতো আলোচনা, সেই রিজার্ভ যে আদম আলীদের ঘামে ভেজা, সে কথা কি মনে রাখে বাংলাদেশ?- এই প্রশ্নটাই যেন উঁকি দিয়ে আরও বিষন্নতার উষ্ণতা ছড়িয়ে দিল মরুর বুকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৫
আরএইচ
** ত্যাগে শীর্ষে ইমেজে পেছনে
** মরেও শান্তি নেই কুয়েতে!
** কুয়েতের রক্তচোষা মানুষ
** কুয়েতে রচনার বাংলাদেশ রচনা
** গাড়ি নতুন, ফোন পুরনো!
** ‘আঁততে আর বাংলাদেশত যাইতাম মনে ন হ’
** ব্যাডা মাছ, বেডি মাছ!
** ‘ধরা পড়লে রক্ষা নেই, কুয়েত থাকার সুযোগ নেই’
** কুয়েতে একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ বাংলা মার্কেট
** কুয়েতের রাজধানী
** সবার উপর দেশ
** কুয়েতে সবাই এমপি!
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!