হাওয়াল্লি (কুয়েত) থেকে: দুই মোল্লা। বড় মোল্লা আর ছোট মোল্লা নামে পরিচিত দুই ভাই।
কুয়েতেও তেমনি কাজের অপেক্ষায় দেখা যায় বহু ভিনদেশিদের। এদের কেউ এশিয়ান কেউ বা আফ্রিকান। কাজের অপেক্ষায় থাকা এরা সবাই গৃহকর্মী। সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে গৃহশ্রমের বাজারে বাংলাদেশি নেই। তবে এই শ্রম বাজারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বাংলাদেশিরা। যার কেন্দ্র চুন্নু মোল্লা আর আব্দুল কাদের মোল্লা।
ঢাকার নবাবগঞ্জের শিকারিপাড়া ইউনিয়নের বিষমপুর গ্রামের মহেদ মোল্লার দুই ছেলেই এখন ব্যবসা করেন কুয়েতের হাওয়াল্লিতে। ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, ফিলিপাইন, ক্যামেরুন, ঘানাসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে গৃহকর্মী হিসেবে আমদানি করেন জনশক্তি। এসব গৃহকর্মীরা কাজ করেন কুয়েতিসহ প্রবাসীদের বাসাবাড়িতে। কেউ গৃহপরিচারিকা, কেউ বা গাড়িচালক হিসেবে।
হাওয়াল্লির ইবনে খলদুন সড়কের ইবনে খলদুন কমপ্লেক্সের মোজাম্মা বিন খলদুন ভবন আর আল মিল হাম ভবনের বেইসমেন্টে সারি সারি রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস। প্রতিটি অফিসের ফ্রন্ট ডেক্সে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন দেশের গৃহকর্মীদের জীবন বৃত্তান্ত। আর সামনে চেয়ার পেতে বসা জীবন বৃত্তান্তের সেই মানুষগুলো।
কুয়েতি নারী-পুরুষ বা কুয়েতে বিভিন্ন দেশের অভিবাসীরা সেখানে আসছেন। আরবি আর ইংরেজিতে লেখা জীবন বৃত্তান্তগুলো দেখছেন। সরাসরি কথা বলছেন কর্মীদের সঙ্গে। পছন্দ হলো তো কোনো কথা নেই। সরাসরি বাসাবাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন।
এই ভবনেই দেখা গেলো বহু বাংলাদেশিদের। যারা এই রিক্রুটিং এজেন্সি খুলে বাংলাদেশ বাদে অন্য দেশ থেকে আমদানি করছেন জনশক্তি। ব্যবসাটাও বেশ জমজমাট। এদের প্রত্যেকের অফিসে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা কর্মীদের সাথে নিজ ভাষায় যোগাযোগের জন্যে রয়েছে দোভাষী। কেউ ম্যানেজার পদে কেউ বা এক্সিকিউটিভ পদে।
সেখানে কথা হয় মারিয়াম আল-আদওয়ানি ম্যানপাওয়ার রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল কাদের মোল্লার সঙ্গে। বাংলানিউজকে তিনি জানান, তারা যে সব দেশ থেকে গৃহকর্মী আমদানি করেন সেসব দেশের মানুষদের আসা যাওয়ার খরচ নিজেরাই বহন করেন।
তিনি আরও জানান, এখানে আসা বা আসার অপেক্ষায় রয়েছে এমন সব কর্মীদের জীবন বৃত্তান্ত দেখে পছন্দ হলেই কেবল তাদের বাসাবাড়িতে নিয়োগ দেওয়া হয়। নানা নিয়ম মেনেই এখান থেকে গৃহকর্মী নিতে হয়। তাদের প্রতি আচার-আচরণ, বেতন, সুযোগ-সুবিধা সব কিছুই উল্লেখ থাকে চুক্তিপত্রে।
একশ’ দিনের মধ্যে কর্মস্থল পরিবর্তনের সুযোগও রয়েছে বলে জানিয়ে আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, ধরেন, কোনো কর্মীকে কুয়েতের একটি পরিবারে পাঠানো হলো। সে যদি সেখানে নিজের কাজে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করে তাহলে একশ’ দিনের মধ্যেই তাকে অন্যত্র কাজে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
কর্মীর নিয়োগ থেকে হাত বদলের প্রতিটি ধাপেই নির্দিষ্ট অংকের অর্থিক মুনাফা থাকে বলেও জানান কাদের মোল্লা।
প্রতিবেশী দেশ থেকে গৃহকর্মীরা এলেও বাংলাদেশিরা নেই কেন? -জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের দেশ থেকে আগে গৃহকর্মী আসতো। নানা কারণে সরকারিভাবে এই খাতে লোক পাঠানো বন্ধ রেখেছে সরকার। তবে সৌদিতে এই বাজার চালু করলেও সরকার কেন কুয়েতে গৃহকর্মী পাঠানোর অনুমতি দিচ্ছে না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার কুয়েতের ভিসা বন্ধ থাকাতেও কেউ আসতে পারছেন না এখানে।
সরকার পাঠানো বন্ধ করেছে। আবার কুয়েত দিচ্ছে না ভিসা। সব মিলিয়ে এখানকার শ্রমবাজার এখন অন্যদের দখলে যোগ করেন আব্দুল কাদের মোল্লা।
বাংলাদেশিরা না এলেও থেমে নেই প্রবাসীদের জনশক্তির ব্যবসা। তারা এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে জনশক্তি আমদানি করে জমজমাট করে রেখেছেন এখানকার শ্রমবাজার।
বাজার ঘুরে দেখা গেলো, ফিলিপাইনের কর্মীদের দাপট। একই ধর্মীয় মূল্যবোধ, গৃহকর্মে নিজেদের দক্ষতা, পরিচ্ছন্নতা আর ইংরেজি বলার পারদর্শিতা তাদের শ্রমের বাজারে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। অথচ সুষ্ঠু নীতিমালা আর নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে এই খাতে বাংলাদেশিদের জন্যে সৃষ্টি হতে পারতো অপার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি চুন্নু মোল্লা বাংলানিউজকে জানান, এখানে ভারতীয় শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার রয়েছে তাদের দূতাবাস। তেমনি অন্যান্য শ্রমিকদের ব্যাপারেও স্ব স্ব দেশের দূতাবাস বেশ তৎপর।
সৌদি আরবের মতো দেশে যেখানে নতুন করে খাদ্দামা (গৃহ পরিচারিকা) পাঠানো হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ সরকারকে আরও তৎপর হতে হবে। অন্যান্য দেশের শ্রমিকরা ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে বাংলাদেশি শ্রমিকরা কেন পাবে না? এখানে কোনো শ্রমিককে লাঞ্ছিত বা নিগৃহীত করলে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। তাদের অধিকার নিশ্চিত করে জরুরি ভিত্তিতে সম্ভাবনাময় এই বাজারে দ্রুত বাংলাদেশিদের প্রবেশ করা প্রয়োজন- যোগ করেন এই জনশক্তি ব্যবসায়ী।
একই ছাদের নিচে লায়লা বেগম নামে আরেক জনশক্তি ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে জানান, আমাদের কষ্ট হয়। যখন দেখি আমাদের হাত ধরেই ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে অথচ নিজের দেশ থেকে একটি মানুষকেও এখানে কাজের সুযোগ দিতে পারি না। সরকারের উচিৎ এই খাতের সমস্যাগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে তা সমাধান করা। অন্যান্য দেশের মতো এই খাতেও কর্মী পাঠানো, তাদের অভিবাসী ব্যয় নিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করা।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৫
জেডআর/এমজেএফ/
** মরুর বুকে ধূসর জীবন
** ত্যাগে শীর্ষে ইমেজে পেছনে
** মরেও শান্তি নেই কুয়েতে!
** কুয়েতের রক্তচোষা মানুষ
** কুয়েতে রচনার বাংলাদেশ রচনা
** গাড়ি নতুন, ফোন পুরনো!
** ‘আঁততে আর বাংলাদেশত যাইতাম মনে ন হ’
** ব্যাডা মাছ, বেডি মাছ!
** ‘ধরা পড়লে রক্ষা নেই, কুয়েত থাকার সুযোগ নেই’
** কুয়েতে একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ বাংলা মার্কেট
** কুয়েতের রাজধানী
** সবার উপর দেশ
** কুয়েতে সবাই এমপি!
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!