শার্ক (কুয়েত) থেকে: যদি জিজ্ঞেস করেন পচা মাছের দুর্গন্ধে এখানে কেউ কখনও নাকে রুমাল চেপেছিলো কিনা? অতীত ঘেটে তা মনে করতে পারবে না কেউই। কারণ পচার সঙ্গে দুর্গন্ধ শব্দটিও নিষিদ্ধ এই মাছের বাজারে।
ঝকঝকে তকতকে মাছের বাজার। সবখানেই তরতাজা মাছের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশের মতো মাছ আর ফলমূলের সঙ্গে ফরমালিনের সমার্থক শব্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না এখানে।
ফরমালিন কী তা জানে না এখানকার স্থায়ী অধিবাসীরা। একটু পর পরই বাজারে আসছেন মৎস্য পরিদর্শকরা। তারা যাচাই বাছাই করে দেখছেন কোনো মাছ পচার উপক্রম কিনা। পচা হলে রক্ষা নেই। হয় জরিমানা, নয় মাছ জব্দ। ফলাফল ব্যবসা বন্ধ। তাই পচা মাছ বিক্রির ঝুঁকিও নেই এখানে।
মনে পড়ে দেশের মাছের বাজারের কথা। কোনো একদিন পচা মাছ দিয়েছিলো দোকানি। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন এটা তো স্বপ্নের ব্যাপার। বাস্তবে এমন কখনো হয় নাকি? তাও অন্তত মাছের বাজারে। আসলেই হয়। আর সেটা এই পারস্য সাগরের তীরে। কুয়েতের শার্ক এলাকায়। সামনে বিশাল পার্কিং। বাইরে থেকে মনে হবে কোনো প্রাসাদ। বিশাল নান্দনিক স্থাপনা। ভবনটির স্থাপত্য এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে, সেখানে সদ্য যাওয়া অনারবদের (আরব নয়) আনাড়ি চোখে মনে হয় কোনো প্যালেস বা রাজকীয় প্রাসাদ।
কুয়েতিদের কাছে যার পরিচয় সেন্ট্রাল ফিশ মার্কেট। আর এই মাছের বাজারটিই এখন রুটিরুজির ঠিকানা বহু বাংলাদেশির।
পারস্য সাগরের বাঁধানো কোল ঘেষে গড়ে ওঠা এ ফিশ মার্কেটে কাজ করেন শতাধিক বাংলাদেশি।
প্রথম প্রথম এই বাজারে কাজ করতে এসে দেশের অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাস্তবকে মেলাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের।
কুয়েতি ধনাঢ্য ব্যক্তি বা অভিবাসীরা সুপারশপের মতো এখানে আসেন সপরিবারে মাছ কিনতে। প্রত্যেক সারিতে অসংখ্য মাছের দোকান। দু’দিকে থরে থরে সাজানো নানা রকমের মাছ। মধ্যখানে প্রশস্ত করিডর। বাংলাদেশিদের কেউ এখানে মাছ বিক্রি করেন, কেউ কর্মচারী। কেউবা আবার মাছ কাটাকুটির শেষে ধুয়ে দেওয়ার কাজটি করেন।
তবে নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশি বা অন্য দেশের অভিবাসীদের এখানে ব্যবসা করতে হয় কুয়েতিদের নামে। তাদের লাইসেন্স নিয়ে। এজন্য লাভের একটি অংশও দিতে হয় তাদের।
সাগরের হরেক রকম মাছ মিলবে এখানে। কাঁকড়া থেকে স্কুইড। ইলিশ থেকে শ্যামন সব ধরনের মাছই রয়েছে এই বাজারে।
সদ্য যাওয়া বাংলাদেশি হিসেবে এই বাজারে হারিয়ে যেতে হয় মাছের ভিড়ে। প্রায় সব মাছই আমাদের অপরিচিত। তবে আশার কথা স্বদেশি চেহারার মাছের ব্যবসায়ীদের সুবাদে দেখা মিলবে নিজেদের দেশে দেখা বেশ কিছু প্রজাতির মাছ।
তার মধ্যে মিলবে রুই, বোয়াল, কাতলা, কাচকি, পুটিঁ, ইলিশ, চিংড়ি, স্কুইড, সুরমা আর কাকঁড়ার।
অপরিচিতের মধ্যে হামুর, বালুর, সিম, ইসমাহি এনাম, চানার বা সুরমা, সল্ট ফিস (মিজলিগান), গুরগুফান, মুছা, কফা, রাউস (চিম) সোম, ক্যাট ফিস, লেডি ফিস, সল্টফিস। নইবি (বাটা মাছের মতো) নিগ্রোসহ নানা জাতের মাছ।
এসব মাছের বেশির ভাগই আমদানি করা হয় সৌদি আরব, ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক, ভারত, মিশর, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে। দামও তুলনামূলক কম। এক থেকে চার কিংবা পাঁচ দিনারে মিলবে কেজিপ্রতি এসব মাছ। কুয়েতের এক দিনারে সমান বাংলাদেশি প্রায় আড়াই’শ টাকা।
কুমিল্লার মুরাদনগরের মামুন মিয়া দোকান ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করেন এই বাজারে। প্রতি মাসে তাকে দোকান ভাড়া বাবদই গুণতে হয় ৪৭৫ কুয়েতি দিনার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা প্রায় সোয়া একলাখ টাকা।
মামুন একা নন। ছোটভাই রমিজ আর তমিজসহ তিনজন রয়েছে ব্যবসা দেখভালের জন্য। এতো টাকা ভাড়া দিয়ে ব্যবসা কেমন চলে?
‘বেশ ভালো আছি, শান্তিতে আছি। দোয়া করবেন, অনেক কুয়েতি আমার নিয়মিত কাষ্টমার’- মুখভরা হাসি নিয়ে বললেন মামুন মিয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাহাঙ্গীর আলমও ব্যবসা করেন এই বাজারে। তিনি জানান, কুয়েত সাগর ছাড়াও সৌদি এবং আশেপাশের দেশ থেকে মাছ আসে তার দোকানে। এখানকার বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারের চিত্র মিলবে না কখনোই।
প্রতি মুহূর্তে রেগুলেটারি অথোরিটির লোকজন বাজার পরিদর্শন করছেন। পরিদর্শকরা দেখছেন, কেউ পচা মাছ রেখেছে কিনা? কারো জন্যে বাজারের ছিমছাপ সুন্দর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে কিনা?
‘সিস্টেমে পড়ে এখানে কিন্তু সবাই ভালো ও সৎ ব্যবসায়ী হয়েছেন’- যোগ করেন জাহাঙ্গীর।
তার মতে এখানে ওজনে কারচুপি বা প্রতারণার কোনো বালাই নেই। সততা আর বিশ্বস্ততাই এখানাকার বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গী।
অনেকে যেমন নিজেরাই ব্যবসা করেন। তেমনি অনেকে কুয়েতি মালিকের অধীনে এই বাজারে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। কেউ বা আবার করেন ভিন্ন কাজ। কোনো ক্রেতা বাজারে আসতে না আসতেই পিছু নেন তার। যদি মাছগুলো কেটে ধুয়ে দেওয়ার কাজটি পান সে আশায়।
এভাবেই এই মাছের বাজারের একটি বড় অংশজুড়েই রয়েছে বাংলাদেশ। পাসপোর্ট বাংলাদেশের। তবে এখানে সবাই কিন্তু অনর্গল কথা বলছেন আরবিতে। আর স্বদেশি চেহারা দেখলে তো কথাই নেই। মুখে খই ফোটে বাংলার।
‘কী মাছ নেবেন ভাই? কোনটা দেবো? কত কেজি দেবো? এমন বাক্যে স্বদেশি ক্রেতাদের আকর্ষণ করেন তারা।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেখানে সততা আর বিশ্বস্ততার সঙ্গে ব্যবসা করে নিজেদের অনন্য মর্যাদায় তুলে ধরেছেন। সেখানে বাংলাদেশের বাজারে কেন উল্টো চিত্র?
‘ভাইরে সবই সিস্টেম, সিস্টেমে পইড়্যা এইখানে সবাই সোজা হইয়্যা যায়’- এই কথা বলেই হাসতে থাকলেন বাংলাদেশের জাহাঙ্গীর আলম।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৫
টিআই
** ভালো নেই মরু জাহাজের নাবিকরা
** গৃহশ্রমের বাজারের হর্তাকর্তা দুই মোল্লা
** মরুর বুকে ধূসর জীবন
** ত্যাগে শীর্ষে ইমেজে পেছনে
** মরেও শান্তি নেই কুয়েতে!
** কুয়েতের রক্তচোষা মানুষ
** কুয়েতে রচনার বাংলাদেশ রচনা
** গাড়ি নতুন, ফোন পুরনো!
** ‘আঁততে আর বাংলাদেশত যাইতাম মনে ন হ’
** ব্যাডা মাছ, বেডি মাছ!
** ‘ধরা পড়লে রক্ষা নেই, কুয়েত থাকার সুযোগ নেই’
** কুয়েতে একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ বাংলা মার্কেট
** কুয়েতের রাজধানী
** সবার উপর দেশ
** কুয়েতে সবাই এমপি!
** সেই ‘ছোট মানুষটিই’ কুয়েতের বড় ব্যবসায়ী
** কুয়েতের বাতাসে ধ্বনিত হয় বাংলা
** কুয়েতের ডাক্তার আপা
** ‘জীবন যুদ্ধ কইত্যে কইত্যে একটা জায়গায় পৌঁছাইছি’
** কুয়েতে তথ্য প্রযুক্তি খাতে সেনা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ
** আইনে নেই, তবুও বেআইনি চর্চা
** পরিবেশ পেলে বিনিয়োগ যাবে কুয়েত থেকে
** কুয়েতের জন্যে বাংলাদেশের আত্মত্যাগ
** কুয়েত পুনর্গঠনে বাংলাদেশ
** কুয়েতে বাংলাদেশের ‘প্রিন্স’ সহিদ
** হয়রানি ও নাজেহালের শিকার হচ্ছেন প্রবাসীর
** অলিদের বঞ্চনা দেখার কেউ নেই
** শিল্প-সাহিত্যেও পিছিয়ে নেই প্রবাসীরা
** বাংলাদেশিদের কাজের ঠিকানা সুলাইবিয়ার ফল-সবজির বাজারও
** পরিবর্তনের দূত মেজর জেনারেল আসহাব উদ্দিন
** কুয়েতে মানবতার ফেরিওয়ালারা!
** সততা আর নিষ্ঠা থাকলে ঠেকায় কে?
** মরুর বুকে বুকভরা নিঃশ্বাস
** শ্রমিকদের মাথার মুকুট আব্দুর রাজ্জাক
** আরব সাগর থেকে হিমেল বাতাসে ভর করে এলো ছন্দ
** মরুর কুয়েত সবুজ চাদরে ঢাকছেন নাফিস জাহান
** ফেব্রুয়ারিতেই খুলনার মারুফের জীবনে আসছে পূর্ণতা!
** কুয়েতে গুলশান!
** কুয়েতের অ্যাম্বাসেডর!
** জন্ম কুয়েতে, হৃদয় বাংলাদেশের
** সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে চট্টগ্রামের শাহজাহানের
** ধূসর মরুভূমিতে সবুজ স্বপ্ন!