লক্ষ্মীপুর: বিয়ের চার মাসের মাথায় তৃতীয় স্ত্রী আয়শা আক্তার লিপিকে (২৬) হত্যার দায়ে তার স্বামী মো. হারুন (৩৭) ও মো. সোহেল (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) দুপুরে এ রায় দেন।
রায়ের সময় মামলার প্রধান আসামি হারুন আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। মামলা চলাকালে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে আত্মগোপন করেছেন তিনি।
হারুনের নামে তার দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা বেগমকে হত্যার অভিযোগেও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় একটি মামলা রয়েছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতি ও নোয়াখালীর সুধারাম থানায়ও তার নামে মামলা রয়েছে।
অপর আসামি সোহেল আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তিনি সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরভূতা গ্রামের মো. সিরাজ আনছারের ছেলে।
এ মামলায় আদালত আরেক মো. সোহেল ও নুর মোহাম্মদ নামে দুই আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত হারুন লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার উত্তর চর কালকিনি গ্রামের ছৈয়াল বাড়ির নুর মোহাম্মদের ছেলে। ভিকটিম লিপি তার তৃতীয় স্ত্রী। দণ্ডপ্রাপ্ত হারুনও লিপির তৃতীয় স্বামী।
মামলার এজাহার ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চর মনসা গ্রামের সুতারগোপ্তা এলাকার একটি পানির ড্রেন থেকে এক নারীর মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে মৃতদেহটির পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার ময়নাতদন্তের পর বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় সদর থানা পুলিশের সেই সময়ের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পাশের ভবানীগঞ্জের চরভূতা গ্রামের মো. সিরাজ আনছারের ছেলে মো. সোহেল ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কাশেমের ছেলে মো. সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ দুজনের মধ্যে সোহেল পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করে পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেন।
তারা পুলিশকে জানান, ঘটনার রাতে অজ্ঞাত ওই নারীকে তারা ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ভবানীগঞ্জের মিয়ারবেড়ি সংলগ্ন একটি মৎস্য খামারে নিয়ে যান। সেখানে তারা দুজন ওই নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে তারা ওই নারীকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করে মৃতদেহ ড্রেনে ফেলে দেন। ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এ দুজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেন৷ এতে ওই ভিকটিম নারীকে অজ্ঞাত হিসেবে দেখানো হয়।
তবে ঘটনার সাত মাস পর ওই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়। নিহত নারী আয়শা আক্তার লিপি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের মিয়াপুর এলাকার জগমোহনপুর গ্রামের আসলাম মিয়ার মেয়ে। তার পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর হত্যা মামলা নতুন মোড় নেয়। তার মা নিলুফা আক্তার আদালতে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করেন।
২০১৮ সালের ২১ আগস্ট হত্যা মামলাটির সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন সদর থানার সেই সময়ের পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মোসলেহ উদ্দিন। পুলিশ লিপির স্বামী হারুন ও হারুনে সহকর্মী নুর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে হারুন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
পরে হারুনকে হত্যাকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত করে চারজনের নামে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্ত কর্মকর্তা।
তদন্তে উঠে আসে, হারুন পরপর তিনটি বিয়ে করেন। এর মধ্যে তার দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা বেগমকে হত্যার দায়ে তিনি ২৬ মাস কুমিল্লার কারাগারে বন্দি ছিলেন। জামিনে বেরিয়ে তিনি কুমিল্লার ইপিজেডের একটি সোয়েটার কারখানায় সিকিউরিটির পদে চাকরি নিয়েছিলেন। ওই কারখানার শ্রমিক আয়শা আক্তার লিপির সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলে তারা ২০১৬ সালের ৯ জুলাই বিয়ে করেন৷ পরে তারা কারখানার পাশে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। বিয়ের সময় হারুন ও লিপি দুজনই তাদের অতিত গোপন করেছিলেন। বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই হারুন তার স্ত্রী সম্পর্কে জানতে পারেন যে লিপির আগে দুই বিয়ে হয়েছে এবং লিপি পাঁচ বছর ওমানে ছিলেন। দেশে আসার পর থেকে তিনি বিভিন্ন দেশের পুরুষদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে হিন্দি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলতেন। এসব করতে হারুন তার স্ত্রী লিপিকে নিষেধ করলেও তিনি শোনেননি। তাই লিপিকে হত্যার পরিকল্পনা করেন হারুন। পরিকল্পনার বিষয়টি তিনি তার সহকর্মী নুর মোহাম্মদকে জানিয়েছিলেন। নুর মোহাম্মদ তাকে হত্যায় সহযোগিতার আশ্বাসও দেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন তার স্ত্রী লিপিকে নিয়ে বিয়ের চার মাস পর ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে নিয়ে আসেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাকে সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জের আধারমানিক গ্রামের এক বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন হারুন। পথে লক্ষ্মীপুর-রামগতি সড়কের সুতারগোপ্তা এলাকার একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে লিপিকে হত্যা করে মৃতদেহ ড্রেনে ফেলে দেন হারুন।
এদিকে ঘটনার দ্বিতীয় আসামি সোহেল পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অজ্ঞাত নারীকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যার পর মৃতদেহ ড্রেনে ফেলে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ঘটনার বর্ণনা ভিন্ন দিলেও হারুন ও সোহেল দুজনই হত্যার দায় স্বীকার করেছেন।
জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. জসিম উদ্দিন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, চারজন আসামির মধ্যে হারুন ও সোহেল আদালতে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় পৃথক স্বীকারোক্তি দেন। আদালত তাদের দুজনের কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন৷ বাকি দুজন কোনো জবানবন্দি দেননি। তারা খালাস পেয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৮, ২০২৩
এসআই