ঢাকা: নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্যদ্রব্য কেউ মজুদ করলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এই অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হতে পারে।
এই বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিল-২০২৩’ পাস হয়েছে।
পাস হওয়া এ আইনটি কার্যকর হলে পলিশিং ও কাটিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা মিনিকেট চাল বিক্রি ও সরবরাহ আইনগত অবৈধ হবে।
বুধবার(৫ জুলাই) জাতীয় সংসদ অধিবেশনে বিলটি পাসের প্রস্তাব করেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। পরে বিলটি কণ্ঠভোটে পাস হয়।
এরআগে বিরোধী দলের সদস্যদের আনা জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি করা হয়। এ সময় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন।
১৯৫৬ সালের ফুড (স্পেশাল কোর্ট) অ্যাক্ট এবং ১৯৭৯ সালের ফুডগ্রেইনস সাপ্লাই (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিটি) অর্ডিন্যান্স বাতিল করে নতুন এই আইনটি করা হলো।
বিলের সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কাজী ফিরোজ রশীদ আইনটি ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে উল্লেখ করে বলেন, আইনটি কার্যকর হলে ঘুষের বাণিজ্য বাড়বে। কেউ বাড়িতে নিজের উৎপাদিত ধান রাখলেও তাকে শাস্তি পেতে হবে। আবার পরিকল্পিতভাবেও অনেককে ফাঁসানোর সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, কোথাও যদি খাদ্য মজুদ না করা যায়, তাহলে কৃষক উৎপাদিত পণ্য কোথায় বিক্রি করবে? তারা উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হবে। দ্রব্যমূল্য আরও বাড়বে। আবার মিনিকেট, কাটারি ভোগসহ অন্যান্য চাল নিষিদ্ধ করলে মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা চালের ব্র্যান্ডিং বন্ধ করতে বাধ্য হবে। এতে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমদানিকে উৎসাহিত করতে এই বিলটি আনা হয়েছে।
ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান গণফোরামের মোকাব্বির খান।
তিনি বলেন, খাদ্যমন্ত্রী নিজেও একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফসলের ন্যায্য মূল পাচ্ছেন না তারা। তাই মজুতের সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এসব বক্তব্যের পালটা জবাবে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনটি পাসের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে খাদ্যদ্রব্য মজুদের সুযোগ থাকবে না। বরং খাদ্য ও খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। ফলে সাধারণ মানুষ অনেক বেশি লাভবান হবে।
কৃষকেরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নিয়েছে।
পাস হওয়া বিলে বলা হয়েছে, এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণে সারাদেশে প্রয়োজনীয়সংখ্যক আদালত থাকবে। এই আদালত খাদ্যদ্রব্য বিশেষ আদালত নামে অভিহিত হবে। এই আইনের অধীনে কিছু অপরাধের বিচার মোবাইল কোর্টেও করা যাবে। খাদ্যদ্রব্য বলতে যেকোনো প্রকার দানাদার খাদ্যদ্রব্য যথা- চাল, ধান, গম, আটা, ভুট্টা ইত্যাদিকে বুঝানো হয়েছে বলে বিলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিলে বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত পরিমাণের বেশি পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলে বা মজুত সংক্রান্ত সরকারের কোনো নির্দেশনা অমান্য করলে তা হবে অপরাধ। এর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড।
তবে এইরূপ অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি আর্থিক বা অন্য কোনো প্রকার লাভের উদ্দেশ্য ব্যতীত মজুদ করেছিলেন তাহলে তিনি অনূর্ধ্ব ৩ মাস কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই অপরাধ হবে অজামিনযোগ্য।
এ বিলে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি পুরাতন খাদ্যদ্রব্য পলিশিং বা অন্য কোন খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশ্রণ করে বা সরকার কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহকালে সরকারি গুদামে রক্ষিত খাদ্যদ্রব্য বৈধ বা অবৈধভাবে সংগ্রহ করে, দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য; বা সরকারি গুদামের পুরাতন বা বিতরণকৃত সিল বা বিতরণ করা হয়েছে, এমন চিহ্নযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ বা আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণগত বা গুণগত পরিবর্তন করে বা অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্যে সরকারি গুদামে সরবরাহ করলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
আর কোন ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন সম্পর্কিত কোন মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি তৈরি, মুদ্রণ, প্রকাশ, প্রচার বা বিতরণ করলে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিলে বলা হয়েছে, কোনো অনুমোদিত জাতের খাদ্যশস্য থেকে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যকে ওই রূপ জাতের উপজাত পণ্য হিসেবে উল্লেখ না করে ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বিপণন করলে বা খাদ্যদ্রব্যের স্বাভাবিক উপাদানকে সম্পূর্ণ বা আংশিক পরিবর্তন করে উৎপাদন বা বিপণন করলে সেটি অপরাধ হবে।
এছাড়া খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিম উপাদান মিশ্রণ করে উৎপাদন ও বিপণন করাও হবে অপরাধ। লাইসেন্স ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দিয়ে ব্যবসা চললেও তা অপরাধ হবে। আর এসব অপরাধের জন্য ২ বছর কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৮ ঘণ্টা, জুলাই ৫, ২০২৩
এসকে/এসএএইচ