ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

কাঠগড়ায় হাসিখুশি ছিলেন ‘আয়না ঘরের’ কারিগর জিয়াউল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৪
কাঠগড়ায় হাসিখুশি ছিলেন ‘আয়না ঘরের’ কারিগর জিয়াউল গণহত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানসহ ৮ আসামিকে বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয় | ছবি: শাকিল আহমেদ

ঢাকা: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সব আসমির মুখে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেছে, কারো চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কাঠগড়ায় বেশ হাসিখুশি সময় কাটিয়েছেন ‘আয়না ঘরের’ কারিগরখ্যাত জিয়াউল আহসান।

হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনীর পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া এই মেজর জেনারেল ছিলেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনসহ ৮ আসামিকে বুধবার (২০ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় তোলা হয়। আট আসামির মধ্যে জিয়াউল আহসান ছাড়া বাকি সবাই পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা।

বুধবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় যখন তোলা হচ্ছিল এই ৮ আসামিকে তখন সবার মুখে ছিল চিন্তার ছাপ। ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্না করেছেন গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক। তবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বেশ হাসিখুশি দেখা গেছে জিয়াউল আহসানকে।

এ দিন এক ঘণ্টা ২০ মিনিট বিচারকাজ চলেছে। কাঠগড়ায় প্রবেশ করা থেকে বের হওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় জিয়াউল আহসান ছিলেন হাসিখুশি।

ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের সামনে এবং প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে যাওয়ার আগে সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা চিৎকার করে বলেন, ‘আমি কখনো আয়না ঘরে চাকরি করিনি। আমার নামে ফেসবুকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। আমি যেখানে কাজ করেছি, সেটা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল ছিল। ’ 

কাঠগড়ায় ওঠানোর পর থেকে অন্যরা যখন চিন্তিত, অনেকে আবার দুশ্চিন্তায় ঠোঁট নাড়িয়ে দোয়া পড়েছেন। সেখানে জিয়াউল আহসান কাঠগড়ার আশেপাশে থাকা লোকজন ও সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে ইশারায় খোঁজখবর নেন ও কথা বলতে চান। মাঝেমধ্যে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে চারদিকে থাকা সবাইকে ভালমতো পর্যবেক্ষণ করেন।

এ সময় তার পরনে ছিল হালকা সবুজ রঙের ফুল হাতা শার্ট ও গ্যাভার্ডিন প্যান্ট। কাঠগড়ায় থাকা অবস্থায় মাঝেমধ্যে পকেট থেকে বের করে টিস্যুর ভাঁজ খুলে কিছু একটা খেতে দেখা যায় তাকে।

বেলা ১১টা ২০ মিনিটে বিচারকাজ শুরু হয়। প্রথমে আইনজীবী নাজনীন আহসান দাঁড়ান জিয়াউল আহসানের পক্ষে। আইনজীবী নাজনীন জিয়াউল আহসানের আপন বোন। এজলাশের মধ্যে ওকালতনামায় জিয়াউল আহসানকে স্বাক্ষর করানোর জন্য আইনজীবী নাজনীন আদালতের অনুমতি চান।

ওকালতনামায় সই করাতে হলে আদালতে আসার আগে প্রশাসনের মাধ্যমে করাতে হয়, এমন প্রশ্ন তুলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। পরে আদালত অনুমতি দিলে জিয়াউল আহসানের স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতের সামনে সাবেক আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে, সেসব তুলে ধরেন।

প্রথমে চিফ প্রসিকিউটর পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন। এরপর ‘সার্ভিয়ান কসাইয়ের’ সঙ্গে জিয়াউল আহসানের তুলনা করে তার ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন তিনি।

তাজুল ইসলাম বলেন, সার্ভিয়ান কসাইয়ের সঙ্গে জিয়াউল আহসানের তুলনা করলে কম হবে। আয়না ঘর বানানোর পেছনে তার ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি দেশে যত কল রেকর্ড ফাঁস হতো তার পেছনে জিয়াউল আহসানের হাত থাকত। একইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনটিএমসির সবার ওপর আঁড়ি পাতার যে টেকনলজি ছিল, তা বাংলাদেশে প্রথম আনেন তিনি।

চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে গুম-খুনের অভিযোগ আছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ আরও অনেক গুম-খুনের পেছনে তার হাত ছিল। তিনি এনটিএমসির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরোধীদের নজরদারি করতেন। জুলাই আন্দোলনে ইন্টারনেট বন্ধের পেছনেও তার হাত ছিল।

এরপর চিফ প্রসিকিউটর ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফির ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হকের ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর। এ সময় তিনি ভুলবশত গুলশান থানার সাবেক ওসিকে সাভারের ওসি বলে উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন। এ সময় মাজহারুল হক দাঁড়িয়ে বিচারকের উদ্দেশে কান্নাকাটি করে বলেন, ‘আমি কখনোই সাভারের ওসি ছিলাম না, আমি গুলশানের ওসি’।

কান্নাকাটি করতে করতে গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক আরও বলেন, ‘আমি আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম। আমার ছেলেও আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। আমি কখনোই সাভারের ওসি ছিলাম না। আমি গুলশানের ওসি। ’

এ সময় চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার বলেন, ‘আপনি নির্দোষ হলে আপনার কিছু হবে না’।

আদালতে দায়িত্বে থাকা পুলিশের এক সদস্য ও সরকার পক্ষের আইনজীবীরা ওসি মাজহারুলকে কথা বলতে নিষেধ করেন। তারা বলেন, আদালতের অনুমতি ছাড়া তিনি কথা বলতে পারবেন না।

এ সময় চিফ প্রসিকিউটর আদালতকে বলেন, লিখিত কাগজটি পড়ার সময় আমি ভুলবশত তাকে সাভারের ওসি বলি। তিনি গুলশানের ওসি। এরপর গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হকে বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তিনি আদালতের সামনে পাঠ করেন।

গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো সম্পর্কে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় অভিযুক্ত গুলশানের ওসি মাজহারুল হক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সঙ্গে মিলে ছাত্র-জনতার ওপর পাষবিক নির্যাতন চালান। তার নির্দেশে ১৯ জুলাই পুলিশ বাহাদুর হোসেন নামের একজনের ওপর গুলি চালায়। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। একই দিন শাহজাদপুরে আরও কয়েকজন ছাত্র-জনতার ওপর ওসি মাজহারুলের নির্দেশে গুলি চালানো হয়।

এরপর ১২টা ১০ মিনিটে চিফ প্রসিকিউটর যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক (ওসি) আবুল হাসানের ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরে বলেন, ছাত্র আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করা হয় যাত্রাবাড়ীতে আবুল হাসানের নেতৃত্বে। তার নির্দেশে সেখানে শত শত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় পুলিশ। পাশাপাশি নিজেরা খুন করে সাধারণ ছাত্র জনতাকে ধরে এনে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে নিয়ে অত্যাচার করা হতো।

পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনসহ এনটিএমসি'র সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসানসহ ৮ জন সাবেক কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে আগামী ১৯ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়াসহ আসামিদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া আসামিরা হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান, ঢাকা জেলা সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, মিরপুরের সাবেক ডিসি মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক, ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৪
ইএসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।