ধর্ম অবমাননা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অপরাধগুলো আমাদের বিদ্যমান আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে বহু বছর আগে থেকেই। দণ্ডবিধি ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের বিভিন্ন ধারায় ধর্ম অবমাননার যে শাস্তি ছিল ২০০৬ সালে এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে সেই শাস্তি আরো বাড়ানো হয়েছে।
গ্রিক শব্দ ব্লাসফেমেন থেকে ব্লাসফেমি শব্দের উৎপত্তি। যার অর্থ ধর্ম নিন্দা বা ঈশ্বর নিন্দা। এক কথায় কারো ওপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করা বা সম্মানে আঘাত করাই ব্লাসফেমি। তবে ব্লাসফেমি বলতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান বোঝায়।
কোনো ব্যক্তি এসব অপরাধ করলে যে আইনে তার বিচার করা হয়, সেটাকেই ব্লাসফেমি আইন বলে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত ঈশ্বরের প্রতিনিধি, তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা, এইভাবে রাজার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগনের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেই জন্য ওই সময় ব্লাসফেমি নামের আইন তৈরি হয়েছিল।
ইউরোপে সর্বপ্রথম এই আইনের প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে ব্লাসফেমি আইন চালু রয়েছে।
ধর্মীয় অবমাননার উদ্দেশ্যে কিছু লেখা :
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ২৯৫ক ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অসদুদ্দেশ্যে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দ্বারা কিংবা দৃশ্যমান অঙ্গভঙ্গি দ্বারা সংশ্লিষ্ট ধর্মটিকে বা কারো ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অবমাননা করে বা অবমাননার চেষ্টা করে, সে ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিকে দুই বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ড অথবা অর্থদণ্ড কিংবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৮৬০ সালের মূল আইনে এ ধারাটি ছিল না। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে এক সংশোধনীর মাধ্যমে এ ধারাটি যুক্ত করা হয়।
প্রমাণের বিষয়
এই ধারার অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে:
ক. অভিযুক্ত ব্যক্তি কিছু বলেছিলেন বা কোনো শব্দ লিখেছিলেন বা কোন ভাবভঙ্গি করেছিলেন।
খ. অভিযুক্ত ব্যক্তি ওইরকম কাজ করে কোনো ধর্মকে বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করেছিলেন।
গ. অভিযুক্ত ব্যক্তি উক্ত শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত আনার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত এবং বিদ্বেষাত্মকভাবে করেছিলেন।
এ বিষয়ে উচ্চতর আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ
(১) কোনো কাজ ইচ্ছাকৃত হতে পারে কিন্তু বিদ্বেষাত্মক নাও হতে পারে। ২৯৫ক ধারার অপরাধের জন্য এ দুই প্রকার অভিপ্রায়ই থাকা প্রয়োজন। অন্য কথায়, জেনে, শুনে, দেখে, বুঝে এবং বিদ্বেষাত্মকভাবে যে ব্যক্তি কোন ধর্মকে আঘাত করে, সেই ব্যক্তি এই ধারায় দোষী হয়
(২) বিদ্বেষ বলতে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অকল্যাণ কামনা করা বোঝায়। এটাই এই শব্দের সাধারণ অর্থ। কিন্তু আইনে বিদ্বেষাত্মকভাবে বললে অন্যের ক্ষতিজনক কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করাকে বোঝায়। যখন কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যের ক্ষতিকর কোনো কাজ করেন, তখন তিনি বিদ্বেষাত্মকভাবে কাজ করেছিলেন বলে ধরা হয়। সাধারণভাবে বিদ্বেষ বলতে গেলে অন্যের সাথে শত্রুতা বা অন্যের বিরুদ্ধে অমঙ্গল কামনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু আইনের ভাষায় বিদ্বেষাত্মক বলতে অন্যের ক্ষতি হতে পারে ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করা বোঝায় ।
(৩) অন্য দেশে একই প্রকার বই প্রকাশিত হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয় নাই, একই কথা বলে বা এই অজুহাত তুলে কোনো ধর্মীয় অবমাননাকর বই রচনা বা প্রকাশের দায় হতে মুক্তি পাওয়া যায় না।
(৪) অন্য ব্যক্তি তার ধর্ম আক্রমণ করেছেন বলে তিনি ঐ ব্যক্তির ধর্মের বিরুদ্ধে অবমাননাকর কিছু লিখেছেন, এই অজুহাতও আইনে গ্রহণযোগ্য নয় ।
(৫) ধর্ম প্রবর্তক, প্রচারক এবং মুনী-ঋষীদের সম্পর্কে কটাক্ষ করা বা তাদের ব্যক্তিগত জীবনের কুৎসা কাহিনী বর্ণনা করা বা প্রচার করা এই ধারানুযায়ী অপরাধ (লাহোর বনাম সম্রাট)।
(৬) ২৯৫ক ধারার উপাদান তখনই পূর্ণ হয় যখন এটা প্রতিষ্ঠিত হয় যে পরিকল্পিতভাবে এবং বিদ্বেষত্মাকভাবে কোনো ধর্মকে অবমাননা করা হয়েছে। যখন কোনো ধর্মকে ধর্মীয় চেতনা অবমামনা করার জন্য আপত্তি করা হয় এবং এমন কোন নির্ভরযোগ্য বিষয় থাকে না যার উপর ভিত্তি করে তাকে সমর্থন করা যায় তখন আদালত এটা অনুমান করে নিতে পারে যে, এটা পরিকল্পিতভাবে এবং বিদ্বেষাত্মকভাবে করা হয়েছে।
লেখকঃ আইনবিষয়ক পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘সময়ের দিগন্ত’র সম্পাদক-প্রকাশক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও পিএইচ.ডি গবেষক।