আইনের চোখে সবাই সমান। রাষ্ট্রের সব নাগরিকই আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
আমাদের সংবিধান বলছে, আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার শুধু অধিকারই নয়, মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত। মৌলিক অধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করতে আইনত বাধ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নাগরিকদের এসকল মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তবে আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু শর্ত ও পদ্ধতি আরোপ করেছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কিছু শর্ত ও পদ্ধতির কথা বলা আছে যা পূরণ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রয়োগ করা যায়। বিদ্যমান আদালতের মাধ্যমেই মানুষের এ অধিকার প্রয়োগ করার বিধান আছে। রাষ্ট্র আদালতের মাধ্যমে নাগরিকদের এ অধিকার প্রয়োগ করে থাকে।
শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রকে একইভাবে কিছু শর্ত মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্র একই অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার ফৌজদারীতে কার্যক্রমে সোপর্দ ও দণ্ডিত করতে পারে না। অর্থাৎ কোনো নাগরিক একই অপরাধের জন্য দুইবার শাস্তি ভোগ করবে না।
এছাড়া আরো বলা আছে, ফৌজদারী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দ্রুত ও প্রকাশ্য বিচারলাভের অধিকারী হবেন।
আদালত হতে হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। এ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ আদালতেই অপরাধীদের বিচার হতে হবে। প্রকাশ্য আদালতে বিচার পাওয়া নাগরিকদের অধিকার। একই সাথে বিচার হতে হবে দ্রুত ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়। তবে দ্রুত বিচার করতে গিয়ে ন্যায় বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
আইনের কাছে আশ্রয় লাভের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ। বলা হয়েছে, “আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষতঃ আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে। ”
তাই সংবিধান অনুযায়ীই বাংলাদেশের সব নাগরিক ও দেশে অবস্থানরত অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও তাদের জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। সব নাগরিকই রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদালতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী।
তবে, রাষ্ট্র যে শর্তহীনভাবে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট। ২৭ অনুচ্ছেদ নাগরিকের আইনের অধিকার লাভের মৌলিক অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ”
রাষ্ট্র সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তার সাথে সাথে সেই অধিকার কার্যকর করার জন্য দায়িত্বও গ্রহণ করেছে। সংবিধানে বলা আছে, (অনুচ্ছেদ-১০২এর ১) “কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির আবেদনক্রমে এই সংবিধানের তৃতীয় ভাগের দ্বারা অর্পিত অধিকারসমূহের যে কোনো একটি বলবৎ করিবার জন্য প্রজাতন্ত্রের বিষয়াবলীর সহিত সম্পর্কিত কোনো দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিসহ যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে হাইকোর্ট বিভাগ উপযুক্ত নির্দেশাবলী বা আদেশাবলী দান করিতে পারিবেন। ”
মূল কথা হলো, রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের আবেদক্রমে মৌলিক অধিকার খর্ব হলে সেক্ষেত্রে যথাযথ আদালতের মাধ্যমে তার প্রয়োগ হতে পারে।
সংবিধানে হাইকোর্টের ওপর এ দায়িত্ব ন্যাস্ত করা আছে। উচ্চ আদালতে কোনো নাগরিক রিট করে তার অধিকার ভঙ্গ হলে তা প্রয়োগের জন্য আবেদন করতে পারে।
আর্ন্তজাতিক আইনেও বিষয়টি নানাভাবেই স্বীকৃত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের সর্বজনীন সনদে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এই ঘোষণা প্রদান করা হয়।
ওই সনদের ৩ অনুচ্ছেদও বলছে, প্রত্যেকেরই জীবন-ধারণ, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে৷
ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি অধিকার রক্ষা করা সব নাগরিকেরই অধিকার। রাষ্ট্রগুলো আর্ন্তজাতিক আইনের মাধ্যমে এ অধিকার প্রদানের জন্য অঙ্গীকার করেছে। সনদের অনুচ্ছেদ ৭ও বলছে, আইনের কাছে সকলেই সমান এবং কোনোরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে৷
এই ঘোষণাপত্রের লঙ্ঘনজনিত বৈষম্য বা এরূপ বৈষম্যের উস্কানির বিরুদ্ধে সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকারও সকলেরই আছে৷
কোনো দণ্ডযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হলেও প্রত্যেকেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। আইন বলছে, গণ-আদালত কর্তৃক আইন অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হওয়ার অধিকারও প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। আইনের কাছে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত সবাই নির্দোষ।
আইন সবাইকে নির্দোষ বলেই মনে করে। আইনের চোখে সবাই নির্দোষ। যদি কোনো ব্যক্তি কাউকে দোষী সাব্যস্ত করতে চায় তবে তা অভিযোগকারীকেই প্রমাণ করতে হবে। আইন কাউকে দোষী বলে মনে করেনা। তবে এরও কিছু ব্যতিক্রম আছে।
নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্র আইনানুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নাগরিকদেরও আইনের মাধ্যমই নিজ নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৪