বর্তমান সময়ে দেশের রাজনৈতিক সন্ত্রাস বৃদ্ধির ফলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক আটকের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। প্রতিদিন গণমাধ্যমে চোখ রাখলেই সারা দেশে শতশত রাজনৈতিক সন্ত্রাসী আটক ও গ্রেফতারের খবর আমরা দেখি।
শুধু বাংলাদেশ নয় সারা বিশ্বে লাখ লাখ অভিযুক্ত ব্যক্তি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করার অভিযোগে কারাগারে অন্তরীণ থেকে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। যদিও বিচারান্তে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সকল অভিযুক্তকে আইনগতভাবে নির্দোষ বলে গণ্য করা হয়, তারপরও ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিচারপুর্ব আটকের মাধ্যমে কারাগারে অন্তরীণরাখাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
বিচারপূর্ব আটক অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আটক ব্যক্তির কাছ থেকে অপরাধ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। যা বিচারের সময় অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যদিও অনেক সময় আইন-শৃংখলা বাহীনির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে যে আটক অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতন করা হয়ে থাকে। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে ঘুষ প্রদানে বাধ্য করা হয়। তারপরও অপরাধ সংঘটিত হলে বা অপরাধ সংঘটন করবে মর্মে সুনির্দিষ্ট তথ্য থাকলে অবশ্য অতি দ্রুত অভিযুক্তকে আটক করে বিচারে সমর্পন করা উচিত।
এতে করে পুনরায় অপরাধ সংঘটন থেকে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিবৃত করা যায় এবং বিচার কার্যক্রম পরিচালনা সহজতর হয়।
বিচারপূর্ব সকল আটকই যে অযৌতিক তা কিন্তু নয়। যেক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক রাখা না হলে তা ন্যায় বিচারের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে অন্য কোনো বিকল্প না থাকলে বিচারপূর্ব আটক রাখা যেতে পারে। কিন্তু বিচক্ষণতার সাথে পর্যালোচনা করতে হবে যেন তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হলে যতদিন সাজা প্রাপ্ত হত, তাঁর চেয়ে বেশীদিন তারা বিচার পূর্ব আটক না থাকে।
সাধারণত দেখা যায় যারা গরীব ও সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর তারা শুধুমাত্র জামিন নেওয়ার জন্য ভাল আইনজীবী নিয়োগ অথবা তদবীর করতে না পারায় তাদের বেশীভাগ দীর্ঘদিন বিচারপূর্ব আটক থাকতে হয়।
বিচারপূর্ব কারাগারে আটক সকল ব্যক্তিই যে সত্যিকার অর্থে দোষী তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে বা ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তাদের আটক করে কারাগারে অন্তরীণ রাখা হয়। যারা অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা, নির্যাতন এবং শারীরিক ও মানসিক অপব্যবহারের শিকার হন।
বিশেষ করে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে তারা নির্যাতনের শিকার হন।
আন্তর্জাতিক আইন ও মানদণ্ড অনুযায়ী কারাগারে অন্তরীণ আটক ব্যক্তিকে শাস্তি প্রাপ্ত কয়েদীদের কাছ থেকে পৃথক রাখার নিয়ম মানা হলেও তাদের কয়েদীদের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রাখা হয়। কারাগারের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ব্যক্তিদের আটক রাখার ফলে খুব গাদাগাদি করে থাকতে হয়। তাছাড়া, সাধারণ শিক্ষা, কারীগরি শিক্ষা, বিনোদনসহ কাজের সুযোগের ক্ষেত্রে বিচারপূর্ব আটক ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদীদের চেয়ে অনেক কম সুযোগ পেয়ে থাকে।
বিচারপূর্ব আটক দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল অন্তরায়। বিচারপুর্ব আটকের ফলে পেশাগত সুযোগ ব্যহত হয়। ফলে শুধুমাত্র যে তার আয় বন্ধ হয়ে যায় তা নয়, আটক ব্যক্তির মুক্তির জন্য তাঁর পরিবারকে আইনজীবীর ফিস ও আদালত সংক্রান্ত অন্যান্য খরচের যোগান দিতে হয়।
দেশের সার্বিক আইনশৃংখলা রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিচারপূর্ব আটকের পর একটি নির্দিষ্ট যুক্তিযুক্ত সময় পর্যন্ত বিচারপূর্ব কারাগারে অন্তরীণ রাখা প্রয়োজন হতে পারে, তবে তা কোনভাবেই যেন সীমাহীন সময়ের জন্য না হয়।
লেখক: মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবী; জাস্টিসমেকার্স ফেলো, সুইজারল্যান্ড; ইমেইলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৫