বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পরিবেশ ও মানবাধিকারের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এ সম্পর্ক ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে।
সহজ কথায় বললে, জলবায়ু পরিবর্তন মানবাধিকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নতুন নতুন স্বাস্থ্য ঝুঁকি, অভিবাসন, খাদ্য ও পানি সরবরাহ, জীবন-জীবিকা ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন সব কিছুই জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতা যতোই বাড়বে, সামগ্রিক মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি হয়ে পড়বে আরো কঠিন।
পরিবেশ ও মানবাধিকারের এ বিপরীতমুখী অবস্থানে ভারসাম্য বজায় রাখাই আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের এ সর্বব্যাপী প্রভাব বিরাজ করার পরও মানবাধিকারের সাথে এর সম্পর্ককে আজো আমরা আইনি রুপ দিতে পারিনি। আইনের জগতে পরিবেশের অবস্থা যথেষ্ট মজবুত হলেও অধিকারের খাতায় পরিবেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নাম লেখাতে পারেনি।
অর্থাৎ সম্পর্ককে সবাই বাস্তবে স্বীকার করলেও আইনগতভাবে এর কোনো স্বীকৃতি নেই। আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার দলিলে এমনকি রাষ্ট্রীয় আইনেও এর স্বীকৃতির বিষয়টি জোড়ালে অবস্থান পায়নি। কিন্তু তাই বলে পরিবেশ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ থেমে নেই। বিশ্বের সব রাষ্ট্রই পরিবেশের গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিবেশ সংরক্ষণ বা জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ নিয়ে অনেক আগে থেকে কাজ হলেও অধিকারের দৃষ্টিতে পরিবেশকে দেখার সূচনা বেশি দিন আগের নয়। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ২০০৭ সালে মালে ঘোষণা ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থায় গৃহীত দুটি প্রস্তাবে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানবাধিকারের সম্পর্ককে আবিষ্কার করি।
সবগুলো ঘোষণাতেই বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রেক্ষাপটটি অত্যন্ত গুরুত্বসহ তুলে ধরা হয়। পরিবেশ ও অধিকারের সম্পর্কের বিষয়টি মানবাধিকার ধারণার একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। এ দৃষ্টিভঙ্গি যতোই স্বচ্ছ ও সুদূরপ্রসারি হবে, ততোই মানবাধিকারের জন্য মঙ্গল।
পরিবেশ অধিকার প্রতিষ্ঠার দরদ উন্নত রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতেই বেশি থাকার কথা। কারণ, জলবায়ু বিপর্যয়ের প্রথম শিকার উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রগুলোতে কেবল মানুষের অধিকারই নয়, তাদের পুরো বসতবাড়ি ও জীবন-সংস্কৃতিই হুমকির মুখে। ক্ষতিগ্রস্ত এ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আছে মালদ্বীপ, মার্শাল দ্বিপ, টুভালু ইত্যদি। তাই পরিবেশ শুধু একটি মানবাধিকারই নয়, অস্তিত্বেরও অধিকার।
আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশ অধিকার রক্ষার পাশাপাশি জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরো ব্যাপক। পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশ রক্ষা-দুটোর দায়ভার রাষ্ট্রকেই প্রথম নিতে হয়। রাষ্ট্রকেই মানুষের অধিকার বাস্তবায়ন করতে হয়। সেজন্য প্রথমে রাষ্ট্রকে এ অধিকার স্বীকার করে নিতে হয়।
কিন্তু অধিকাংশ রাষ্ট্রই পরিবেশকে শুধু একটি দূষণজনীত অপরাধ হিসেবে দেখছে। তাই পরিবেশ দূষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়নে তারা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু অপরাধের শাস্তি দিলেই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়না। আমেরিকায় পরিবেশ দূষণের জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও উষ্ণতা রোধের আর্ন্তজাতিক প্রটকল এখনো ঝুলে আছে সেই আমেরিকার জন্যই। কাজেই ধারণা বা মতবাদের প্রচলনের চেয়ে তা বাস্তবায়নের গুরুত্ব বেশি। তাই রাষ্ট্রের দর্শনগত অবস্থান এখানে জরুরি।
আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিবেশ অধিকার ধারণাটির সবচেয় বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানবাধিকার নীতি, পরিবেশ নীতি ও কৌশলের সাথে সমন্বয়ের অভাব।
আমরা যদি ধরত্রীর পবিত্রতা, একত্ববাদ ও আন্তনির্ভরশীলতার কথা স্বীকার করি (১৯৯১ সালের আমেরিকার পরিবেশ নেতৃত্ব বিষয়ক সম্মেল) তাহলে জলবায়ু পরিবতর্নের ক্ষেত্রে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে সমানতালে।
বৈষম্যহীন মানবিক সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন পারস্পরিক মর্যাদাবোধ, ন্যায়বিচার ও বেষম্যহীন একটি ব্যবস্থা। আর এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে পরিবেশ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সম্ভব না।
পরিবেশবাদীরা পরিবেশের অধিকারকে তৃতীয় প্রজন্মের মানবাধিকার হিসেবে অভিহিত করতে চান। কিন্তু এ অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে এ প্রজন্মকেই। কারণ, তৃতীয় প্রজন্মের হাতে এ অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা আর কিছুই বাকি থাকবেনা। বর্তমান প্রজন্ম ইতোমধ্যেই এর প্রভাব পেতে শুরু করেছে।
প্রয়োজন রয়েছে রাষ্ট্রগুলোর নিজস্ব পরিমণ্ডলে আইন প্রণয়ন করার। বিশ্বের অন্তত ১০৫টি রাষ্ট্র পরিবেশ বিষয়ক বিধান প্রণয়ন করেছে। পরিবেশগত ন্যায়বিচারকে আর মানবাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। তাই রাষ্ট্রকে ‘পরিবেশ’কে দেখতে হবে অধিকারের দৃষ্টিতে। এটি হতে হবে রাষ্ট্রের দর্শনগত অবস্থান।
ভবিষ্যতে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে পরিবেশ ও প্রতিবেশ যতই হুমকির মুখে পড়বে, ততই জোরালো হয়ে উঠবে 'পরিবেশগত ন্যায়বিচার'-এর ধারণা। তাই রাষ্ট্র ও বিশ্বকে ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারে স্বার্থে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলতে এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন। শুধু তৃতীয় প্রজন্মের নয়, বর্তমান প্রজন্মেরও।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৭ ঘণ্টা, মে ২৮, ২০১৫