যৌতুক একটি সামাজিক অভিশাপ। যৌতুককে নারী-নির্যাতনের মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যৌতুকের অভিশাপ থেকে নারী সমাজ তথা রাষ্ট্রকে বাঁচাতে রয়েছে আইন। কিন্তু একের পর এক আইন করেও যৌতুক তথা নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাচ্ছেনা।
যৌতুকের কারনে নারী নির্যাতনের কোনো সঠিক হিসাব আমাদের নাই। সব নির্যাতনের কথা গণমাধ্যমে আসেনা। দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায় নারী নির্যাতনের অনেক করুণ কাহিনী।
ইউএনডিপি’র এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, বাংলাদেশে শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আমরা নারীর ক্ষমতায়ন বা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দাবী করি, ওপরের তথ্যটি যদি সঠিক হয়, তবে তা এক ভিন্ন বাস্তবতার সাক্ষ্য দেয়।
নারী নির্যাতনের ভয়াবহতা বা চরিত্রের রকম ফের হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু নির্যাতনের হার কমেনি। এক সময় এসিড নিক্ষেপ সমাজে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যেতো দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এখন যদিও তার ভয়াবহতা কিছুটা কমেছে। তবে নতুন রূপে দেখা দিয়েছে অভিনব নির্যাতনের কৌশল।
নারী নির্যাতন বলতে আমরা কেবল নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের কথাই বুঝি। কিন্তু এ ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। প্রচলিত এ ধারণার ফলে নারী নির্যাতনের প্রায় অর্ধেক চিত্রই থেকে যায় দৃষ্টির আড়ালে। যেকোনো ধরণের মানসিক নির্যাতনও নারী নির্যাতনের অর্ন্তভূক্ত। কাউকে পদে পদে খোঁটা দেওয়াও যে নারী নির্যাতন হতে পারে সে ধারণা আমাদের নেই।
ফলে, নারী নির্যাতনের সঙ্গা নির্ধারণ প্রথমে জরুরি। নারী নির্যাতনের প্রকৃত ধারণা না থাকলে এর আকার, প্রকার ও ব্যাপতার প্রকৃত চিত্র আমরা পাবোনা।
আইনে নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও নিষ্পেণই নারী নির্যাতনের অর্ন্তভূক্ত। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, ধর্মীয়, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় ও এমনটি কর্মক্ষেত্রেও নারীর প্রতি যেকোনো ধরনের নির্যাতন বা বৈষম্য আরোপ করা দণ্ডনীয় অপরাধ।
অর্থাৎ যেকোনো রকমের নির্যাতন, যৌন হয়রানী, এসিড নিক্ষেপ, তালাক, যৌতুক, নারী পাচার, গণিকা বৃত্তি, পরিবারে নারী নিগ্রহ, অপহরণ, উত্যক্ত করা সবই এখন নারী নির্যাতন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সব অপরাধেরই শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।
আবার নারী পাচার, অপহরণ, এসিড অপরাধ দমন, তালাক ও পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট আইনও আছে।
কিন্তু আইন থাকাই শেষ কথা নয়। আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা ছাড়া কোনো আইনই কার্যকর হতে পারেনা। মানুষের সচেতনা ও সম্পৃক্ততা ছাড়া আইনের সুফল পাওয়া সম্ভব না। সেকারণেই দেশে যৌতুক বিরোধী আইন থাকার পরও যৌতুকের ঘটনা কমছেনা। কমছেনা যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন।
যৌতুক ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে প্রচুর মামলাও হচ্ছে। কিন্তু সে মামলার নিষ্পত্তির হার ও নতুন মামলা রুজু হওয়ার মধ্যে ব্যাপক ঘাটতি বিদ্যমান। ফলে, প্রতি বছরই অনিষ্পণ্ন মামলার সাথে যোগ হচ্ছে আরো নতুন মামলা। সৃষ্টি হচ্ছে মামলা জট।
মামলা জটের আরো কারণের মধ্যে আছে, বিচারকের অভাব, সাক্ষীর অভাব, আসামীর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব, আইনজীবীদের যথাযথ পদক্ষেপের অভাব ইত্যাদি।
যৌতুক দেয়া-নেয়া দুটোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ১৯৮০ সালে পর ২০০০ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়। ২০০৩ সালে তা আবার সংশোধনও করা হয়। এ আইনে বলা হয়, যদি কোনো নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি যৌতুকের জন্য কোনো নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, অথবা কোনো নারীকে কোনো রকমের জখম করেন, তবে ঐ স্বামী, স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা ব্যক্তি-
মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদণ্ডে বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উভয় ক্ষেত্রে ওই দণ্ডের অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। কাজেই, যৌতুকের কারণে কোনো নারীকে শারীরিক নির্যাতন, জখম বা মৃত্য ঘটানো হলে সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এছাড়া জখম বা শারীরিক অন্যান্য নির্যাতনের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ নানা ধরনের শাস্তির বিধানতো আছেই। এ শাস্তি কেবল প্রত্যক্ষ নির্যাতনকারীরই নয়, পরোক্ষভাবে যারা এতে সহায়তা করেন বা মদদ দেন তারাও শাস্তির আওতায়।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে উদ্বিগ্নতা তা এখন আর কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় সীমার মধ্যে আবদ্ধ নেই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা । পৃথিবীর সব রাষ্ট্রেই নারী নির্যাতনের শিকার হয়। সব ধরণের মানবাধিকার লংঘনেরই প্রাথমিক শিকার হয় নারী ও শিশুরা। হোক তা শান্তি বা যুদ্ধাবস্থা।
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নারী নির্যাতন যে মানবাধিকারের লংঘন সে বিষয়টি আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পায়।
তবে তারও আগে ১৯৪৮ সালের মানবাধিকার সনদেই নারীর প্রতি কোনো রকম বৈষম্য না করা কথা বলা আছে। তবে তা নারী অধিকারের দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের সাধারণ নীতির ওপর ভিত্তি করেই প্রণীত হয় মানবাধিকারের সনদ।
এখানে লক্ষ্যণীয়, মানবাধিকার সনদে যে বৈষম্যহীন বিশ্বব্যাবস্থার প্রত্যাশা করা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী বঞ্ছনার শিকার। এটি ১৯৪৮ সালে যেমন সত্য, তেমনি সত্য ১৯৭৯ সালে কিংবা ১৯৯৩ সালে।
মানবাধিকার ঘোষণার প্রথম অনুচ্ছেদেই আছে সব মানুষের সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু নারীকি আজো সম মর্যাদা পাচ্ছে? আবার অনুচ্ছেদ ২-এ যে বৈষম্যহীন বিশ্বব্যাবস্থার কথা বলা হয়েছে, সেখানে নারীর অবস্থান কোথায়?
১৯৪৮ সালের মানবাধিকারের একিভূত দৃষ্টি থেকে নারীকে পৃথক দৃষ্টিতে দেখার প্রয়োজন ছিল। প্রায় ৩০ বছরের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৭৯ সালে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ করা সনদ গ্রহণ করা হলো। যা ওই পৃথক দৃষ্টিতে নারীকে দেখার চেষ্টারই ফল। রাষ্ট্রগুলো সে সনদ গ্রহণ ও স্বাক্ষর করলো। অত:পর প্রয়োজ দেখা দিল নারীর চোখে বিশ্বকে দেখার। কিন্তু নারীকে দেখার বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১৫