সারা দেশের বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে বিরোধের কারণগুলো চিহ্নিত করতে একটি উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ছয় মাসের মধ্যে এই কমিশন গঠন করতে হবে।
আমাদের আইন বিষয়ক সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের অভাব। এখানে আইন প্রণয়ন করতে সময় লাগেনা। কিন্তু অনেক আইনই বাস্তবায়নের অভাবে অকার্যকর হয়ে যায়। বিদ্যমান বাড়িভাড়া আইনটিও সেরকমই একটি আইন। দুই যুগ পার হলেও এ আইনের সুফল দেশের ভাড়াটিয়ারা পায়নি। ফলে, বাড়িভাড়া সংশ্লিষ্ট জটিলতা, বিরোধ ও অস্থিরতাগুলো এখনো বিরাজ করছে।
এমন একটি প্রেক্ষাপটেই আইনজীবী মনজিল মোরসেদ হাইকোর্টে এ রিটটি দায়ের করেন। আদেশে বলা হয়, গঠিত কমিশন মালিক ও ভাড়াটিয়াদের বিরোধ নিষ্পত্তি ও বাড়িভাড়া নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে সেই সাথে এলাকাভেদে গণশুনানি করে ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণ ও বিরোধের বিষয়ে সুপারিশ করবে।
বাড়ি ভাড়া নিয়ে মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে বিরোধের অন্ত নেই। বাড়ি ভাড়া নেয়া থেকে শুরু করে, মাসিক ভাড়া প্রদান, অগ্রিম নির্ধারণ, বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করানো, ইউটিলিটি বিল প্রদান, বাড়ি ভাড়া বাতিল, অগ্রিম ফেরত-সবক্ষেত্রেই বিরোধ লেগে থাকে। এক্ষেত্রে আইন থাকলেও আইনের তোয়াক্কা করছেনা বাড়ির মালিকরা। বাড়ির মালিকের কথাই বাড়িভাড়া আইন।
রিট আদেশের মাধ্যমে গঠিত কমিশন এসব বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারলে তা বাড়িভাড়া ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে। আইন মন্ত্রণালয়ের মনোনীত একজন আইনজ্ঞসহ সাতজন সদস্য নিয়ে কমিশন গঠিত হবে। কমিশনে আরো থাকবেন নগর ও গৃহায়ন বিশেষজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ, বাড়িভাড়া বিষয়ক এনজিও’র একজন প্রতিনিধি,পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় মনোনীত সিটি করপোরেশনের একজন প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ কমিটি গঠন করবেন।
বাড়িভাড়া ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়নই এ কমিশনের কাজ। অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা নিরসনের জন্য কমিশন বাড়িভাড়া আইন ১৯৯১ এর অনুসরণ করবে ও এর বিধানগুলো কার্যকর করতে ভূমিকা রাখবে।
আইনে আছে, ভাড়ার রসিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দিতে হবে। দেশের ক’জন বাড়ির মালিক এ বিধান মেনে চলে? আর বাড়িভাড়ার পরিমাণ নিয়ে কথা বলাই বাহুল্য। নির্ধারিত ভাড়া তালিকা অনুযায়ী দেশের কোথাও বাড়িভাড়া হচ্ছে বলে মনে হয়না।
আইন না মেনেই বাড়ির মালিকরা অগ্রিম ভাড়া আদায় করছেন। দুই মাসের কম অগ্রিম ভাড়া কোনো মালিক নিতে চাননা। এলাকা ও মালিক ভেদে কখনো কখনো তা ছয় মাস, এক বছরে গিয়েও ঠেকে। কিন্তু আইনে সাধারণভাবে কোনো অগ্রিম ভাড়া নেওয়ার বিধান নেই। ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনের ১০ ধারা মোতাবেক নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া কোনো অগ্রিম ভাড়া আদায় করা যাবেনা। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ একমাসের অগ্রিম ভাড়া গ্রহণ করা যেতে পারে। এ বিধানের কোনো লংঘন হলে মালিককে আদায়কৃত ভাড়ার তিনগুণে পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু কেউ কি আইন মানছে? কোনো বাড়িওলাকে আইনের কথা বললে মালিক বাড়ি খালি রাখবে তবু তার কাছে বাড়ি ভাড়া দেবেনা।
ফি বছর ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে আছে আরেক জটিলতা। আইনের ১৬(২) ধারায় বলা আছে, মানসম্মত ভাড়া, বাড়ী-মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, প্রতি দুই বছর পর (নিয়ন্ত্রক কর্তৃক) পুনঃ নির্ধারণ করা যাবে৷’ কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবোর্চ্চে এক বছরের মধ্যেই ভাড়া বৃদ্ধির আওয়াজ তোলা হয়। বর্ধিত ভাড়া দিতে অস্বীকার করলে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার হুমকি। এসব হুমকি মোকাবেলা করেই ভাড়াটিয়ারা দিন যাপন করেন।
কোনো কারণ ছাড়াই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা অতি সাধারণ ঘটনা। অনেক সময় বর্তমান ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে বিব্রত বোধ করলে তাকে উচ্ছেদ করে নতুন ভাড়াটিয়ার কাছে বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়। নতুন ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে বেশি ভাড়ায় বাড়ি ভাড়া দেয়া হয়।
অথচ আইনের ১৮ ধারায় আছে, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়ি ভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না। এমনকি বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
বাড়ির মালিকের এক কথা, মাসের ৫-৭ তারিখের মধ্যে চলতি মাসের ভাড়া দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আইনে আছে যদি কোনো ভাড়াটে প্রতি মাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করলেও তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। কিন্তু পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখ তো পরের কথা, চলতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যেই ভাড়া দিতে হবে।
বাড়ি ভাড়া করার আগে সবাইকেউ উচিত চুক্তিপত্র সম্পাদন করা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো লিখিত চুক্তি থাকেনা। আর চুক্তি হলেও মালিকের ইচ্ছা অনুযায়ী শর্ত আরোপ করা হয়। ৩০০ টাকার লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে নেয়া জরুরি। আর এ চুক্তিতে ভাড়াটিয়াকে আইনের (১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া আইন) বিধান গুলো জেনে সেই অনুযায়ী চুক্তি করতে হবে। আইনের সাথে সাংঘর্ষিক কোনো শর্ত আরোপ করলে তা চুক্তি থেকে বাদ দিতে হবে।
কমিশন গঠিত হলে আশা করা যায়, বাড়ি ভাড়া বিষয়ক অব্যবস্থাপনাগুলো কিছুটা হলেও দূর হবে। মালিক ও ভাড়াটিয়া উভয়কেই আইনানুযায়ী বাড়ি ভাড়া বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩০ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৫