ঢাকা: বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) ১৮তলা ভবন অবৈধ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
বিজিএমইএ’র করা আপিল খারিজ করে বৃহস্পতিবার (০২ জুন) এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ।
১৯৯৮ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজিএমইএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ভবন নির্মাণ শেষ হলে ২০০৬ সালের ৮ অক্টোবর বিজিএমইএ ভবন উদ্বোধন করেন সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এর পর থেকে বিজিএমইএ ভবনটি তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে।
রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই কারওয়ানবাজার সংলগ্ন বেগুনবাড়ি খালে বিজিএমইএ ভবন নির্মাণ করা হয়েছে উল্লেখ করে ২০১০ সালের ২ অক্টোবর ইংরেজি দৈনিক 'নিউ এজ' পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিনই প্রতিবেদনটি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ডি এইচ এম মনির উদ্দিন আদালতে উপস্থাপন করেন।
পরদিন ৩ অক্টোবর বিজিএমইএ ভবন কেন ভাঙার নির্দেশ দেওয়া হবে না, তার কারণ জানতে চেয়ে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে (সুয়োমোটো) রুল জারি করেন। এ রুলের ওপর শুনানিতে আদালতকে আইনি সহায়তা দিতে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের সাতজন আইনজীবীকে আদালত বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই সাত আইনজীবী হলেন- বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ড. আখতার ইমাম, ব্যারিস্টার সারাহ হোসেন, অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ ও পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
২০১১ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ তার রায়ে বিজিএমইএ’র ভবন ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। বিজিএমইএকে নিজস্ব অর্থায়নে ভবনটি ভাঙতে বলা হয়। ভবনটি নির্মাণের আগে ওই স্থানের ভূমি যে অবস্থায় ছিল সে অবস্থায় ফিরিয়ে আনতেও নির্দেশ দেওয়া হয়।
একই বছরের ৫ এপ্রিল বিজিএমইএ’র আবেদনে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। পরবর্তী সময়ে আপিল বিভাগ স্থগিতাদেশের মেয়াদ আরো বাড়ান।
এর দুই বছর পর ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ হাইকোর্টের ৬৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
আদালত রায়ে বলেন, ‘বিজিএমইএ’র ওই ভবনের জমির ওপর কোনো মালিকানা নেই। কেননা জমিটি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল রেলওয়ের জন্য ১৯৬০ সালে। অধিগ্রহণ আইন অনুযায়ী কোনো দাবিদার কর্তৃপক্ষের জন্য শুধু জনস্বার্থে কোনো ভূমি অধিগ্রহণ করা যায়। পরে যদি দাবিদার কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণকৃত জমি বা সে জমির অংশ অপ্রয়োজনীয় মনে করে তাহলে দাবিদার কর্তৃপক্ষ সে জমি সরকার বা জেলা প্রশাসনকে ফেরত দিতে বাধ্য থাকে। এ ব্যাপারে দাবিদার কর্তৃপক্ষের কোনো হাত থাকে না। সরকার সে অবস্থায় হয় ওই জমি অন্য কোনো জনস্বার্থে ব্যবহার করবে অথবা জমি মূল মালিকের কাছে ফেরত দিতে বাধ্য থাকবে’।
আদালত বলেন, ‘এখানে দেখা যাচ্ছে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ যাদের প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল, তারাই মোট ৬.২১ একর জমি অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় ছেড়ে দেয় একই বছরে অর্থাৎ ১৯৬০ সালে। পরে ১৯৯৮ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমি একটি স্মারকের মাধ্যমে বিজিএমইএকে নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য বেআইনিভাবে প্রদান করে। অথচ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ২০০৬ সালের আগ পর্যন্ত আদৌ ওই জমির মালিক ছিল না। অর্থাৎ রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো যা করেছে তা হলো পরের ধনে পোদ্দারি’।
আদালত রায়ে আরও বলেন, ‘২০০১ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো একটি লিখিত কিন্তু নিবন্ধনবিহীন দলিলের মাধ্যমে বেআইনিভাবে ওই জমি থেকে একটি অংশ বিজিএমইএকে প্রদান করার প্রয়াস পায়। অথচ তখনও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ওই জমির মালিকানা পায়নি’।
আদালত বলেন, ‘শুধুমাত্র ২০০৬ সালেই সরকার টুইন টাওয়ার নির্মাণের জন্য একটি সাব কবলার মাধ্যমে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোকে ওই জমি প্রদান করে। ওই প্রদানকে বৈধ বলে ধরা যেতে পারে। কেননা, অন্য একটি জনস্বার্থে অর্থাৎ একটি টুইন টাওয়ার নির্মাণের জন্য রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোকে জমিটি প্রদান করা হয়েছিল নিবন্ধনকৃত সাফ কবলার মাধ্যমে’।
রায়ে বলা হয়, ‘এ থেকে যা দাঁড়ায়, ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো প্রথমবারের মতো ওই জমির মালিকানা পায়। অথচ, ১৯৯৮ ও ২০০১ সালে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো ভৌতিকভাবে ওই জমি বিজিএমইএকে তার নিজস্ব ভবন নির্মাণের জন্য দেওয়ার প্রয়াস পায়’।
রায়ের অভিমতে আদালত বলেন, ‘রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো কোনোক্রমেই বিজিএমইএকে তার নিজস্ব ভবন তৈরির জন্য (যা নির্মাণের পেছনে কোনো জনস্বার্থ জড়িত নাই) জমি প্রদান করতে পারে না। কেননা, অধিগ্রহণকৃত জমি হয় মূল মালিককে ফেরত দিতে হয় অথবা অন্য একটি জনস্বার্থে ব্যবহার করতে হয়’।
আদালত বলেন, ‘বিজিএমইএ ভবন নির্মাণের পেছনে আদৌ কোনো জনস্বার্থ নাই। ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে একান্তই বিজিএমইএ’র সদস্যদের নিজস্ব স্বার্থের খাতিরে। ভবনের একটি বিরাট অংশ ব্যাংকসহ কয়েকজন ব্যক্তি মালিকের কাছে বিক্রিও করা হয়েছে’।
রায়ে বলা হয়, ‘ওই জমি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর বিজিএমইএকে প্রদান শুধু অনধিকার চর্চাই ছিল না, ভূমি অধিগ্রহণ আইনেরও পরিপন্থী ছিল বটে’।
আদালত বলেন, ‘তদুপরি সম্পত্তি হস্তান্তর আইন ও নিবন্ধন আইন অনুযায়ী কোনো জমি লিখিত কবলা ও নিবন্ধন ছাড়া হস্তান্তর করা যায় না। এখানে স্বীকৃতভাবেই এখন পর্যন্ত কবলা বা সাফ কবলা বিজিএমইএ’র নামে নিবন্ধিত হয়নি’।
রায়ে বলা হয়, ‘সবচেয়ে বড় কথা, স্বীকৃতভাবেই দেখা যাচ্ছে, অধিগ্রহণকৃত জমিটি রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো অবৈধভাবে ও অনধিকার চর্চামূলে নেহায়েতই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিজিএমইএ’র কাছে দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে’।
‘সুতরাং যা দাঁড়ায় তা হলো ওই জমির ওপর বিজিএমইএ’র কোনো মালিকানা নেই। মালিকানা একান্তই সরকারের। অর্থাৎ ওই জমি বিজিএমইএ জবরদখল করে আছে এবং অন্য যেকোনো জবরদখলকারীর মতোই বিজিএমইএকে উচ্ছেদ করতে এবং তার ভবন ভেঙে দিতে সরকার বাধ্য বটে’।
হাইকোর্ট রায়ে আরও বলেন, ‘জমিটি অধিগ্রহণকৃত জমি বিধায় সরকারের কাছে দু’টি পথ খোলা আছে। হয় এটি আদি মালিকের কাছে ফেরত দিতে হবে অথবা টুইন টাওয়ার বা অন্য কোনোভাবে বিকল্প জনস্বার্থে ব্যবহার করতে হবে’।
আদালত রায়ে আরও বলেন, ‘এছাড়াও ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে, ঢাকা মাস্টারপ্ল্যান, জলাধার আইন ও রাজউকের অনুমোদন গ্রহণ না করেই। যার ফলেও ভবনটি ভেঙে দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য’।
রায়ে আদালত বলেন, ‘ভবনটি নির্মাণ করে বিজিএমইএ বহু প্রত্যাশিত হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠি দেখাচ্ছে তাদের আর্থিক প্রতিপত্তির কারণে। যা কোনো অবস্থাতেই আইনের শাসনের আঙ্গিকে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না’।
হাইকোর্ট বলেন, ‘বিজিএমইএ’র পক্ষে ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ ও ব্যারিস্টার আখতার ইমাম বলেছেন, বিজিএমইএ এমন একটি সংস্থা যা আমাদের অর্থনীতিতে অসামান্য অবদান রাখে। তাই তাদের ভবন ভাঙা ঠিক হবে না। কোনো অবস্থাতেই এ মতবাদের সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করতে পারি না। কারণ, একটি সংস্থা আর্থিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে এবং দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে বলে তাদের আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে- এ যুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়’।
আদালত আরও বলেন, ‘বিজিএমইএ’র সদস্যরা দেশের অর্থনীতিতে যেমন অবদান রাখছেন, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার জন্য গার্মেন্টস শ্রমিকরাও তেমনি অবদান রাখছেন। যাদের শ্রমের জন্যই গার্মেন্টস কারখানা চলছে। হাজার হাজার প্রবাসী বাঙালিরাও দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে রাখছেন। দরিদ্র কৃষকদের অবদানও কোনো অবস্থাতেই খাটো করার সুযোগ নেই। তাদের শ্রমের বিনিময়ে ফসল উৎপাদন হচ্ছে বলে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা বেচে যাচ্ছে। তাদের উৎপন্ন দ্রব্য না থাকলে বিজিএমইএ’র সদস্যসহ গোটা দেশের জনগণকে উপোষ থাকতে হতো’।
হাইকোর্ট বলেন, ‘সুতরাং আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী বলে একটি শক্তিশালী মহলকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখতে হবে এমন যুক্তি অগ্রহণযোগ্য। দেশের অন্য দশজনের মতো এই আর্থিক পেশিশক্তির অধিকারী লোকেরাও দেশের সাধারণ আইনের আওতাধীন। সংবিধান অনুযায়ী ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আইনের প্রয়োগের ব্যাপারে কোনো বৈষম্য চলতে পারে না’।
আদালত বলেন, ‘বস্তুত একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসাবে বিজিএমইএকে আইনের প্রতি আরও অধিক শ্রদ্ধাশীল হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। অথচ তারা তা না করে আইনকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ব্যবহার করেছেন’।
আদালত রায়ে বলেন, ‘ভবনটি সৌন্দর্য ও মহিমান্বিত হাতিরঝিল প্রকল্পে একটি ক্যান্সারের মতো। এই ধংসাত্মক ভবন অচিরেই বিনষ্ট করা না হলে এটি শুধু হাতিরঝিল প্রকল্পই নয়, সমস্ত ঢাকা শহরকে সংক্রমিত করবে’।
‘সুতরাং সরকার এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের ওপর নির্দেশ হলো, ভবনটি ৯০ দিনের মধ্যে ভেঙে ফেলতে হবে। ওই জমি জনকল্যাণে ব্যবহার করতে হবে। হাতিরঝিল প্রকল্প একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প’।
আদালত বলেন, ‘বিজিএমইএ যাদের কাছে ওই ভবনের ফ্ল্যাট বা অংশ বিক্রি করেছে তাদের টাকা ফেরত দিতে হবে তাদের দাবি পাওয়ার এক বছরের মধ্যে। কারণ, তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল বেআইনি। কেননা, বিজিএমইএ’র ওই ভবন নির্মাণ বা ভবনের অংশ কারো কাছে বিক্রি করার কোনো অধিকার ছিল না। তবে ক্রেতারা যেহেতু নিজেরাও জানতেন বা তাদের জানা উচিত ছিল যে, এই জমির ওপর বিজিএমইএ’র মালিকানা নেই এবং ভবনটি বেআইনিভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, সুতরাং আদালতের মতে, তারা কোনো সুদ পাওয়ার দাবিদার নন।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৫ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৬
ইএস/এএসআর