ঢাকা: `মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করার সামর্থ্য রাখেন'।
সোমবার (০৬ জুন) প্রকাশিত মীর কাসেম আলীর মৃতুদণ্ডের চূড়ান্ত পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
রায়ে আপিল বিভাগ বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল তার শুনানিতে বলেছেন যে, মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে লবিস্ট ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়েছেন। তবে লবিস্ট নিয়োগ করা হয়েছে কি হয়নি সেটা বিচার্য বিষয় নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল লবিস্ট ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার বিষয়ে একটি রশিদ দাখিল করেন। এ দ্বারা প্রমাণিত হয়’ আসামি খুবই বিত্তশালী ব্যক্তি’।
‘২০১২ সালের ১৯ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামির দাখিল করা জামিনের আবেদনে তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার প্রমাণ দিয়েছেন। যেখানে অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে। এসব কিছু প্রমাণ করে, তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার বানচাল করতে ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করার সামর্থ্য রাখেন’।
রায়ে আপিল বিভাগ আরও বলেন, ‘প্রসিকিউশনের পক্ষে দুই প্রসিকিউটর মামলাটি পরিচালনা করেন। তারা যৌথভাবে মামলাটি পরিচালনা করলেও সেটা করেছেন খণ্ডিতভাবে (পিসমিল বেসিস)। দু’জন প্রসিসিকিউটর এই মামলাটি পরিচালনা করেছেন এটা দোষের কিছু নয়। বরং একাধিক প্রসিকিউটর দ্বারা একটি মামলা পরিচালনা করা ভালো’।
‘তবে একাধিক প্রসিকিউটর একটি মামলায় যৌথভাবে যুক্ত থাকলে তাদের মধ্যে পরামর্শ, আলোচনা ও সমন্বয় থাকতে হবে। ওই দু’জন প্রসিকিউটরের এই মামলাটি যৌথভাবে (সমন্বয় না করে) পরিচালনা না করাটা একটি ভুল’।
‘একজন প্রসিকিউটর কিছু সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন, আরেকজন প্রসিকিউটর অন্য সাক্ষী উপস্থাপন করেছেন। এতে তাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব (ল্যাক অব সিকুয়েন্স) তৈরি হয়েছে। মামলা পরিচালনাকারী দু’জন প্রসিকিউটর সাক্ষ্য ও জেরার সময় একসঙ্গে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন না। সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে আমরা একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, দুই প্রসিকিউটরের মধ্যে মামলা পরিচালনায় কোনো সমন্বয় ছিল না’।
সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছ থেকে আমরা জেনেছি, এ ধরনের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে খুবই অভিজ্ঞ ও দক্ষ দু’জন প্রসিকিউটর প্রসিকিউশনে আছেন। কিন্তু রহস্যজনকভাবে তারা এই মামলায় নেই’।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি বহাল রেখে জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর আপিল মামলার ২৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয় সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায়টি দেন। অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
গত ০৮ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর দেওয়া ফাঁসি বহাল রেখে সংক্ষিপ্ত আকারে মীর কাসেম আলীর আপিল মামলার চূড়ান্ত রায় দেন আপিল বিভাগ। ২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশের ওই রায় দেন ট্রাইব্যুনাল।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মূল হোতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শহীদ কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ ছয়জনকে হত্যা-গণহত্যার দায় (১১ নম্বর অভিযোগ) প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে আপিল মামলার রায়ে। ১১ নম্বর ছাড়াও ১২ নম্বর অভিযোগে রঞ্জিত দাস লাতু ও টুন্টু সেন রাজুকে হত্যার দায়েও কাসেমের মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনাল। তবে চূড়ান্ত রায়ে প্রমাণিত না হওয়ায় এ অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত মোট ১০টি অভিযোগের মধ্যে আরও ৬টি অভিযোগে মীর কাসেমের সাজা বহাল এবং আরও ২টি থেকে অব্যাহতি ও খালাস দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসির পাশাপাশি ৫৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন তিনি।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা ছিলেন জামায়াতের বর্তমান কর্মপরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী। সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) ও জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (যৌথ দায়বদ্ধতা) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের দায়ও তাই বর্তেছে তার ওপরে।
ট্রাইব্যুনালে আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মীর কাসেম আলী।
এ ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয় ট্রাইব্যুনালের রায়ে। বাকি ৪টি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি প্রসিকিউশন।
১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি অর্থাৎ ২, ৩, ৪, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৪ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং ৪টি অর্থাৎ ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়।
এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে সর্বসম্মত ও ১২ নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিরা।
ফাঁসি ছাড়াও প্রমাণিত অন্য ৮টি অভিযোগে আরও ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ পান মীর কাসেম আলী। এর মধ্যে প্রমাণিত ফারুককে অপহরণ-নির্যাতনে (২ নম্বর অভিযোগ) ২০ বছর ও নাসির উদ্দিন চৌধুরীকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে নিয়ে নির্যাতনের (১৪ নম্বর অভিযোগ) দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড পান তিনি। এছাড়া অপহরণ, আটক ও নির্যাতন সংক্রান্ত ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
অভিযোগগুলোর মধ্যে ৪, ৬ ও ১১ নম্বর বাদে বাকি ৭টিতেই সাজা বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। ফলে একটিতে ফাঁসি ও দু’টিতে ৭ বছর করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড কমেছে মীর কাসেমের।
বাংলাদেশ সময়: ২২১৩ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৬
ইএস/এএসআর