মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) আলোচিত আদুরী নির্যাতন মামলার এ রায় দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার।
রায়ে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে নদীকে।
নিজের ওপর চার বছর আগে ঘটা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের মামলার রায় শুনতে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে এসেছিল আদুরী। সঙ্গে ছিলেন তার মা সাফিয়া বেগম, খালা শাহিনুর বেগম ও মামা মামলার বাদী নজরুল চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।
পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামের বাড়ি থেকে বর্তমানে ১৪ বছরের কিশোরী আদুরী ও পরিবারের বেশ কয়েকজন লঞ্চযোগে সোমবার (১৭ জুলাই) সকালে ঢাকায় আসেন। রাতে উত্তর বাড্ডায় আদুরীর দুলাভাইয়ের বাসায় অবস্থান করে মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষে আসেন তারা।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আদুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা।
মামলার দুই আসামির মধ্যে গ্রেফতারকৃত আদুরীর গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। রায়ের পর তাকে সাজা পরোয়ানা দিয়ে ফের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জামিনে থাকা অপর আসামি নদীর মা ইশরাত জাহানও আদালতে ছিলেন।
২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় গৃহকর্মী আদুরীকে। উদ্ধারের সময় তার শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন।
পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ২৯/১, সুলতানা প্যালেসের দ্বিতীয় তলায় সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতো শিশু আদুরী।
দীর্ঘদিন মারধর, গরম খুন্তি ও ইস্ত্রির ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ নানা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতন চালিয়ে মৃত ভেবে ওই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন মাসুদের স্ত্রী গৃহকর্ত্রী নদী ও তার পরিবারের লোকজন।
প্রায় দেড় মাস আদুরীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যখন তাকে রিলিজ দেওয়া হয়, তখনও সে ভালোভাবে কথা বলতে পারতো না। শরীর ছিলো প্রচণ্ড দুর্বল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ওই বছরের ০৭ নভেম্বর আদুরী চলে যায় পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে।
নির্যাতনের ঘটনায় তিনদিন পর ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানায় নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে মামলা করেন আদুরীর মামা নজরুল চৌধুরী।
তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ, চুন্নু মীর ও রনিকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানের সম্পৃক্ততা পাওয়ায় নতুন করে তাকে আসামি করা হয়।
মামলার দিনই ২৬ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার করা হয় নদীকে। গ্রেফতারের পর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদুরীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করে ওই বছরের ০১ অক্টোবর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
আদুরীও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়। সে বলেছিল, গৃহকর্ত্রী নদী তাকে দিনে একবেলা খেতে দিতেন, তাও মুড়ি। মাঝে মধ্যে ভাত দিতেন, তাও শুধু লবণ কিংবা মরিচ দিয়ে। থাকতে দিতেন ব্যালকনিতে। আর নির্যাতন চলতো অহরহ।
২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী ও তার মা ইসরাত জাহানকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দেন পুলিশের নারী সহায়তা ও তদন্ত বিভাগের এসআই কুইন আক্তার।
চার্জশিটে বলা হয়, আগেরদিন ধারালো ছুরি দিয়ে গৃহকর্মী আদুরীর শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে গৃহকর্ত্রী নদী মারাত্মক জখম করে শিশুটিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসেন।
২০১৪ সালের ০৬ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এ মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ১৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে গত ০৯ জুলাই রায়ের দিন ১৮ জুলাই ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
বাদীপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আদুরীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি।
বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৭
এমআই/এএসআর
** নদীর যাবজ্জীবনে খুশি আদুরী