ঢাকা, মঙ্গলবার, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংসদের সমালোচনা ঠিক হয়নি’

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৭
‘ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সংসদের সমালোচনা ঠিক হয়নি’

ঢাকা: ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সংসদকে অপরিপক্ক বলে সমালোচনা করা হয়েছে। এটি ঠিক নয়, উচিৎ নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক।

বিচারপতিদের অপসারণে সংসদের ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় নিজ কার্যালয়ে বুধবার (০৯ আগস্ট) এমন মন্তব্য তিনি।

বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ের ৮৩ পৃষ্ঠায় যদি আসি, সেখানে আমরা দেখবো, অথর জাজ (ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের লেখক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) সংসদকে অপরিপক্ক বলে সমালোচনা করেছেন।

এটি ঠিক নয়, উচিৎ নয়। এটাতো ঠিক না যে, একটি কনস্টিটিউশনাল বডি আরেকটি কনস্টিটিউশনাল বডিকে অপরিপক্ক বলবেন বা এমপিদের অপরিপক্ক বলবেন। এটা তো ঠিক না, বিশেষত যখন হাইকোর্টের রায়ে সংসদের সম্মানিত সদস্যদের সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করা হয়েছে’।

‘কাজেই প্রধান বিচারপতি যদি বলেন, পার্লামেন্ট ইজ ইমম্যাচিউরড বা সংসদ সদস্যরা অপরিপক্ক তাহলে তো আমাকে বলতে হয়, অবশ্যই যুক্তিতে চলে আসে যে, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাও তাহলে অপরিপক্ক। কারণ, তারাও তাদের রায়ের মধ্যে যা তাদের বলার দরকারই ছিল না, সংসদ সদস্যদের বিষয়ে সেসব বলেছেন। হাইকোর্টের রায়ে বলার কারণে আপিল বিভাগকে একই ধরনের প্রত্যাহার (এক্সপাঞ্জ) পর্যন্ত করতে হয়েছে’।

খায়রুল হক বলেন, ‘যদি সুপ্রিম কোর্টকে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের অংশবিশেষ এক্সপাঞ্জ করতে হয়, তাহলে তো এটা দৃশ্যমান যে, এটিও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের অপরিপক্কতা। না হলে এক্সপাঞ্জ করার প্রয়োজনীয়তা কেন থাকবে?’

‘এমনকি অথর জাজ তার রায়ের ২০৬ পৃষ্ঠায় সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ক বলেছেন। এটি তো ঠিক বাঞ্ছনীয় নয়। আমরা যদি পরস্পর পরস্পরকে সম্মান করতে না শিখি, একে অপরের প্রতি যদি অসংসদীয় ভাষা ব্যবহার করি, তাহলে যারা বলছেন, সেই দুই পক্ষই তাদের অপরিপক্কতা প্রমাণ করেন’।

গত ০১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। গত ০৩ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।

গত বছরের ০৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে মূল রায়টি দিয়েছিলেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী, বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ।

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। সর্বোচ্চ রায়ের ফলে প্রথম দফার মহাজোট সরকারের আমলে আনা সংশোধনীটি বাতিল হয়ে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে চলে এসেছে।

রায়ের পরে গত ০৬ আগস্ট প্রথম সভাও করেছেন পুনর্বহাল হওয়া সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বলেন, ‘রায়ের ২২৩ ও ২২৪ পৃষ্ঠা এবং আরও অনেক জায়গায় ডিরোগোটরি মার্ক অথর জাজ বলেছেন। এবং এমন কথাও বলেছেন, এমপি হওয়ার আগে তাদের কনসিডার করা উচিৎ যে, তারা এমপি হওয়ার যোগ্য কি-না। সে তিনি এমপি হওয়ার যোগ্য কি-না, সেটা তো যারা ভোটার- তারা বুঝবেন। সর্বোচ্চ আদালত থেকে এ ধরনের মন্তব্য মেনে নেওয়া যায় না’।

‘এখন সংসদ সদস্যরা যদি উল্টো বলেন, হাইকোর্টের জাজরা বিচারপতি হওয়ার উপযুক্ত কি-না- এটি কি তারা বিবেচনা দেখেছেন, কেমন শোনাবে? কথায় তো কথা বাড়ে। এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক কথা কেন উচ্চ আদালতের রায়ে আসবে? আসাটা বাঞ্ছনীয় নয় বলে আমি ও আমরা মনে করি’।

তিনি আরও বলেন, ‘২২৮ পৃষ্ঠায় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, সংসদ অকার্যকর। এটিও তো সঠিক কথা হলো না। সংসদ খুব কার্যকর। তারা অর্থবিল পাস করেছেন, তারা বিচারপতিদের বেতন-ভাতাদি পাস করছেন, তারা সব কাজই তো করছেন’।

সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে বিচারপতি  খায়রুল হক বলেন, ‘বরাবর বলা হয়েছে যে, সংসদ সদস্যরা স্বাধীন নন।   অনুচ্ছেদ ৭০ তাদের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে।   এবং এ কারণেই বলা হয়েছে যে, বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা যেটি ষোড়শ সংশোধনীতে করা হয়েছিল, সেটি সংসদ সদস্যদের হাতে থাকা উচিৎ নয়।   এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা’।

‘আপনারা যদি অনুচ্ছেদ ৭০ পড়ে দেখেন, সেখানে বলা হয়েছে, কোনো সংসদ সদস্য দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন না। যদি দেন তাহলে তার সদস্য পদ বাতিল হয়ে যাবে।   কিন্তু সংসদে কি যায়? বিল।   আইনের খসড়া বিল আকারে যায়।   এ বিলগুলো তো দলের নয়।   সেগুলো বিরোধীপক্ষও আনতে পারেন,  স্বতন্ত্র সদস্যও আনতে পারেন।   কাজেই ভোটাভুটিটা কিন্তু কোনো দলের পক্ষে-বিপক্ষে হয় না, হয় বিলের পক্ষে-বিপক্ষে’।  
 
তিনি বলেন, ‘সংসদ ইচ্ছে করলেই বলতে পারবে না, আমরা মোনার্কি করলাম।   সুপ্রিম জুডিশিয়ারি আমরা খর্ব করে দেবো- পারবে না বলতে।   কারণ, এটি সংবিধানের মূল কাঠামো বা ভিত্তি’।

‘এক্ষেত্রে কি হয়েছে? পরিষ্কার করে বলছেন না। কিন্তু হাবে-ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না থাকলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যাবে। এ কথাটিতে আমি একমত নই।   এর কারণ হলো, বাহাত্তর সালে যখন আমাদের সংবিধান হলো, সেই সংবিধানে যখন ৯৬ অনুচ্ছেদ ছিল, তখনও আমরা সবাই জানতাম, সুপ্রিম কোর্ট জানতেন- বিচার বিভাগের কিছু স্বাধীনতা আছে।   তেহাত্তরেও তাই জানতাম। চুহাত্তরেও জানতাম, যদিও তখনও ৯৬ অনুচ্ছেদ রয়ে গেছে’।  

‘পঁচাত্তরের জানুয়ারি মাসে চতুর্থ সংশোধনীর ভিত্তিতে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা চলে গেলো রাষ্ট্রপতির হাতে। তাতেই পঁচাত্তরে চতুর্থ সংশোধনীর আগ পর্যন্ত এ কথা কেউ বলতে পারবেন না যে, আমাদের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল না।   অনুচ্ছেদ ৯৬ থাকা সত্ত্বেও তখনও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল’।
 
‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সে রকম কোনো সম্পর্ক নেই।   বরং, এটিকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মোড়কে হাতিয়ার হিসেবে করা হচ্ছে’।
 
‘সার্বভৌম জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে সংসদ।   সবারই যখন সংসদের প্রতি জবাবদিহিতা আছে এবং সংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছে, বিচারপতিদের সেটি না হওয়ার তো কোনো কারণ ছিল না? সেটিই ছিল মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে।   যখন আদি ৯৬কে ষোড়শ সংশোধনীতে নিয়ে আসা হলো, সেটিকে ঘোষণা করা হলো অবৈধ।   তাহলে জবাবদিহিতা রইলো কোথায়? জনগণের কাছে তো জবাবদিহিতা আর থাকছে না’।
 
‘আমরা এতোকাল জেনে এসেছি- এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু এ রায়ের পরে মনে হচ্ছে, আমরা আর বেশি দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে থাকছি না।   আমরা গণবিচারপতিতন্ত্রী বাংলাদেশে যাচ্ছি। কারণ, জনগণ তো সরে গেলো এখান থেকে’- বলেন বিচারপতি খায়রুল হক।

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৩ ঘণ্টা, আগস্ট ০৯, ২০১৭
ইএস/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।