বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর দাবি তুলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক’।
এরপর ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি, আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে।
বঙ্গবন্ধুর এমন ঘোষণার পরেও স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা করা হয়নি। কেন হয়নি? কি এমন আইনের জটিলতা ছিল যে এতদিনেও উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা করা সম্ভব হলো না? এসব নিয়ে ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের সঙ্গে।
বাংলানিউজ: দীর্ঘকাল ধরেই উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা করার দাবি উঠেছে। একজন আইনজীবী হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা করার বিষয়ে যে দাবিটি উঠেছে সেটি অত্যন্ত যৌক্তিক এবং সমর্থন-যোগ্য। বাংলাদেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। এসব রায় ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন কী? তবে বাকি যে ৫ শতাংশ রায় আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে, শুধু সেসব রায় ইংরেজিতে অনুবাদ করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে মায়ের ভাষায় আমরা আমাদের আদালতের রায়ও পাবো, আবার অন্যদিকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো তাদের আন্তর্জাতিক ইমেজও হারাবে না।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালের ১ মার্চ ঢাকায় বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘দেশের আদালতে... দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না। সে তো এক লজ্জার ব্যাপার। এ দুর্গতি যত তাড়াতাড়ি দূর হয়, তার জন্য সর্বতোভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ’
অতএব একটি বিষয় সহজেই অনুমেয় যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পূর্ণ সদিচ্ছা এবং সমর্থন রয়েছে দাবিটির প্রতি। যেহেতু আমাদের বিচার বিভাগ নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন, তাই এ বিষয়ে সব শেষ কথা বিচার বিভাগকেই বলতে হবে।
বাংলানিউজ: উচ্চ আদালতের ভাষা বাংলা করার বিষয়ে যৌক্তিক কারণ কী?
তুরিন আফরোজ: মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে হবে। বিচারের রায় লেখা হয় দেশের মানুষের জন্য। তারাই যদি আদালতের রায় সঠিকভাবে বুঝতে না পারে তবে রায় লেখার অর্থ কী? ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কিনা এটা বুঝবে কী করে মানুষ? তাই মহামান্য আদালতের রায়গুলো বাংলা ভাষাতেই লেখাটা প্রত্যাশিত।
বাংলানিউজ: উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে আর কি যৌক্তিকতা আছে বলে মনে করেন?
তুরিন আফরোজ: আমাদের দেশে এমন কিছু মামলা রয়েছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব মামলার রায় বাংলাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, যাতে দেশের সব মানুষ তা বুঝতে পারে অতি সহজেই। এক্ষেত্রে বলতে পারি সংবিধান সংশোধন মামলাই বিচার বিভাগের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এসব ঐতিহাসিক মামলাগুলো ভবিষ্যৎ সব সাংবিধানিক সংকটে আমাদের পথ দেখাবে। এ ধরনের মামলা জাতির আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। সে কারণে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর রায় পড়ার জন্য প্রতিটি নাগরিকের অসীম আগ্রহ। এ ধরনের জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো, বিশেষ করে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত মামলা ও যেসব মামলায় সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হয় সেসব মামলার রায় অবশ্যই বাংলায় দেওয়া ন্যায়সংগত। ’
বাংলানিউজ: বিশ্বের অন্য কোনো দেশে উচ্চ আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারের নজির রয়েছে কি?
তুরিন আফরোজ: বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যেখানে মাতৃভাষাতেই আদালতের রায় লেখা হয়। উদাহরণ হিসেবে আমরা জার্মানি, জাপান অথবা চীনের কথা বলতে পারি। এসব দেশের আদালত নিজেদের মাতৃভাষাতেই রায় লিখে থাকেন। তবে যেসব রায় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র মনে করে যে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো তারা অন্য ভাষায় অনুবাদ করেন। একই পদ্ধতি বাংলাদেশেও অনুসরণ করা যেতে পারে।
বাংলানিউজ: উচ্চ আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
তুরিন আফরোজ: উচ্চ আদালতে বাংলাভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বিচারপতিদেরই নিতে হবে। তারা যখন বাংলায় রায় দেওয়া শুরু করবেন এবং আদালতের অন্য কাজও বাংলায় সম্পাদন করা সমর্থন জানাবেন, তখনই স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে আদালতে একটি বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি গড়ে উঠবে, যেখানে আদালতের সমস্ত কার্যাবলী বাংলায় সম্পন্ন হবে। এমনকি আইনের বইগুলোও বাংলায় রচিত হবে। তাই সময় এসেছে দেশের আদালতে দেশের জনগণের ভাষা ব্যবহার করবার। মায়ের ভাষায় আদালতের রায় লিখতে হবে।
বাংলানিউজ: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
তুরিন আফরোজ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৮
এসএম/এএ