২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কার্যালয়ের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী হতাহত হয়।
রায়ের অপেক্ষমান মামলার বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ তার অফিসে বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। রায় নিয়ে তার প্রত্যাশার কথাও বলেন তিনি।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে তুরিন আফরোজ বলেন, আমাদের উপমহাদেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাস খুবই প্রচলতি একটা বিষয়। এ উপমহাদেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেওয়া।
সেই অর্থে এ ধরনের রাজনৈতিক সন্ত্রাস যে কোনো সময় গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা সবাই অপেক্ষা করে আছি ভয়াল ২১ আগস্টের হামলার বিচারের জন্য। তবে এটা শুধু আমাদের দেশের নয় এ উপমহাদেশের রাজনীতির জন্য চিন্তার একটি বিষয়, যে রায়ে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কিনা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দেওয়ার বহু উদাহরণ এ উপমহাদেশে রয়েছে। যেমন রাজিব গান্ধী, ইন্দিরাগান্ধী, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো, শ্রীলঙ্কার রানা সিংহে প্রেমাদাশা বন্দেরনায়েকে।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে এটিই প্রথম তা কিন্তু না। আগেও আক্রান্ত হতে দেখেছি। যেমনটা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সান্ধ্যআইনজারি করে বিচার বন্ধ করা হয়েছে। সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। ঠিক একইভাবে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য, ধ্বংস করে দেবার জন্য। বিশেষ করে জাতির পিতার পরিবারের কেউ যেন আর রাজনীতিতে না দেখি এরকম একটা উদ্দেশ্য নিয়েই আক্রমণ করা হয়েছিল। সেদিনের চক্রান্তকারীদের বাঁচানোর জন্য অনেক রকম কৌশল করা হয়েছে। এ মামলাটি অনেক ‘রাজনৈতিক সন্ত্রাস’ মামলার চাইতে ভিন্ন। কেননা এখানে রাষ্ট্র তথা সরকার যেখানে নিজেই সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়েছে। সেখানে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি’র অনেক উচ্চ স্থানীয় নেতারা এ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল। তাদের মাধ্যমে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড। এ মামলার প্রমাণ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। বিভিন্ন রকম রাজনৈতিক নাটক, জজ মিয়া নাটক করা সাজানো হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যেহেতু আদালতের হাত ধরে একটি বিচারের রায় প্রত্যাশা করছি। আমরা মনে করি অতীতের কলঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাবে আদালত। এটি শুধু আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বের রাজনীতির জন্য উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বাংলানিউজ: মামলাটি এতো দীর্ঘসূত্রিতার কারণ কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: দেখুন মামলাটি প্রথম থেকেই নানারকম বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেস্টা করা হয়েছে। রায়ে নিশ্চয়ই প্রতিফলিত হবে যে আলামত নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন একটি মামলার আলামত নষ্ট করা হয় তখন নিশ্চয়ই তদন্ত কাজ সঠিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া খুব কঠিন কাজ। তারওপর যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসী হামলা হয় এবং ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা যেটাতে জড়িত থাকেন তাতে তো আলামত নষ্ট করা আরও সহজ হয়ে যায়। কাজেই সত্য মিথ্যার সমস্ত জাল থেকে সত্যিকারের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য খাঁটি সত্যটি বের করে আনার জন্য একটু সময় লেগেছে। তাছাড়া এ মামলার স্বাক্ষীদের সামনে আনাও একটা চ্যালেঞ্জ ছিল।
বাংলানিউজ: বিএনপি নেতাদের দাবি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতেই এ রায় দিতে যাচ্ছে সরকার। তাদের এমন প্রশ্নে আপনি কি মনে করেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: এখানে বড় কথা যদি কেউ অন্যা করে থাকে সেই অন্যায়ের দায়ভার তো তাকে নিতেই হবে। এখন যদি আমরা কারও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেই তাহলে তো ভবিষতে আরও বেশি অন্যায় চলে আসবে আমাদের দেশে। তাছাড়া যিনি অপরাধ করলেন তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের কারও নেই। তাছাড়া ন্যায় বিচার করতে যেয়ে যদি একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করতে হয়; একটি দলকে রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার মধ্য দিয়ে চলে যায় সেটা তো আমাদের মেনে নিতে হবে। কারণ তারাই তো অপরাধটি করেছে।
বাংলানিউজ: বিএনপি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে রায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আপনি কি মনে করেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: মোটেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কোনো ব্যাপার না। কারণ আদালত স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। হ্যাঁ, বলতে পারেন নির্বাচনের সামনেই কেন রায় হচ্ছে? আজ রায় না হয়ে ছয় মাস পরে হলেও তো আগে পরে কোন না কোন নির্বাচন থাকত। সেগুলো দেখে তো আদালত কাজ করে না। আদালত রাজনীতির মাঠ দেখে রায় ঘোষণা করে না। আদলত দেখে যদি আমার কাজ শেষ হয়ে যায়; সমস্ত তথ্য-উপাত্ত যদি সামনে চলে আসে। তারা যদি রায় লেখে ফেলেন সব কিছুই ঠিক হয়ে যায় সেটি বুঝেই সময় নির্ধারণ করেন রাজনীতির ক্যালেন্ডার দেখে বিচারকরা রায় দেন না।
তুরিন আফরোজ বলেন, যে কোন রায় এলেই বলা হয় প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এ রায়। আসলে আদালতের রায়ে সবকিছু সুস্পষ্ট করবে। রায়ে যদি বিএনপি নেতাদের সম্পৃক্ততা চলে আসে তাহলে তো তাদের শাস্তি ভোগ করতে হবেই। এখানে বিশেষ কোনো একটি দল বলে যে পার পেয়ে যাবে সেটা তো আইনের শাসন না। আর আমরা বার বার এ কথা বলে কেন আদালতকে রাজনীতির দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছি। আদালতের সামনে কে আওয়ামী লীগ করে, কে বিএনপি করে, কে জামায়াত করে এটা বিবেচ্য নয়। আদালতের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একজন ব্যক্তি অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা। সুতরাং স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেহেতু এইখানে আসছি, রায় পেতে যাচ্ছি। কাজেই আমাদের আস্থা রাখতে হবে বিচার ব্যবস্থার ওপরে।
বাংলানিউজ: রায়ে আপনার প্রত্যাশা যদি ব্যক্ত করেন?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলভিত্তি হচ্ছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রের সব ধর্ম বর্ণের লোক থাকবে, সব মত থাকবে সেটিকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাতে হবে। শুধু আমি এক রাজনীতিক দল থাকব আরও কেউ রাজনীতি করতে পারবে না সেটি নয়। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা থাকবে, তর্ক বিতর্ক থাকবে লড়াই থাকবে কিন্তু লোক হত্যা করবে, ধ্বংস করা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া এটি গণতন্ত্রের পরিপন্থি। এখানে আমার প্রত্যাশা ভবিষ্যতে কখনই যেন কোন রাজনৈতিক দলকে বা রাজনৈতিক দলের ওপর এধরনের আক্রমণ না হয়। মনে রাখতে হবে যত মত থাকবে তত পথ থাকবে, মত এবং পথের সংমিলনেই কিন্তু গণতন্ত্র বিকশিত হয়।
বাংলানিউজ: রাজনৈতিক মামলাগুলোর রায় বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় দীর্ঘসূত্রিতা লক্ষ্য করা যায়। ই মামলার রায় বাস্তবায়ন নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কি?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: রায় বাস্তবায়ন নির্বাহী ক্ষমতার এখতিয়ার। আমরা অতীতে দেখেছি বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার বিচার শুরু হওয়ার পর সরকার বদল হলেই বিচার বন্ধ হয়ে যেত। আইনের শাসন সবার জন্য সমান হতে হবে। সেখানে যদি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে মামলার রায় রাজনীতি করণের চেষ্টা করা হয় তাহলে সেটি কার্যকর করতে দেরি হবে। আমরা দেখেছি দীর্ঘদিন পরে হলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, রায় কার্যকর হয়েছে আবার যুদ্ধাপরাধীর বিচার হয়েছে, রায় বাস্তবায়নও হয়েছে। আমরা দেখবো এ রায়ও বাস্তবায়তি হবে।
বাংলানিউজ: আগামী নির্বাচনে কোন কারণে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলে রায় পাল্টে যাওয়ার সুযোগ থাকবে কি না?
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ: আমরা আসলে আস্থা রাখতে চাই আদালতের ওপর, বিচারবিভাগের ওপর। সরকার পরিবর্তন হলে হয়তো দীর্ঘ সূত্রিতায় পড়তে পারে কিন্তু ন্যায় বিচার শেষ পর্যন্ত হবেই। বর্তমান বিকশিত গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে রায় পাল্টানো খুবই কষ্টকর ব্যাপার। হয়তো সময় একটু পেছাতে পারে। পুরো রায় পাল্টে নতুন কিছু আসবে এটা বিশ্বাস করি না। এ মামলার রায় আরও আগে হওয়া উচিত ছিল, শেষ পর্যন্ত রায় হচ্ছে এটাই স্বস্তির। এ রায়ে প্রমাণিত হবে রাজনীতির যত বড় নেতাই হোক, অপরাধ করে কেউ পার পেয়ে যাবে তার শাস্তি হবে না, সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে। আমরা ন্যায় বিচারে আশাবাদী।
**বিচারপতি সিনহার সাধের ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল’
**বিচারপতি সিনহার ‘বিচারপতি-বিদ্বেষ’
**‘স্বপ্নচারী সিনহার’ মিথ্যাচার
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০১৮
এসএম/এসএইচ