ঢাকা: ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রে ধূমকেতুর মতো আগমন ঘটেছিল জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ’র। মাত্র চার বছরের অভিনয় ক্যারিয়ারে গগণচুম্বী জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
সালমান শাহ মৃত্যুর পর কেটে গেছে আরও দুই যুগ। তবে এ ২৪ বছরেও তার মৃত্যুর রহস্যের জট খোলেনি। আত্মহত্যা করেছেন সালমান শাহ, তিনবার এমন প্রতিবেদন এসেছে। তবে এসব প্রতিবেদনে যেমন আস্থা রাখতে পারছে না সালমান শাহ’র পরিবার, তেমনি ভক্তরাও তা মানতে পারছেন না।
সবশেষ গত ২৫ ফেব্রুয়ারি পিবিআই সালমান শাহ’র মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়। পিবিআইয়ের পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলামের করা ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন বলেই উল্লেখ করা হয়।
পিবিআইয়ের এ প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলা চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা সালমান শাহ হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি, তিনি পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছিলেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহের আত্মহত্যার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করা হয়। সেগুলো হলো- চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে সালমানের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা, স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহ, মাত্রাধিক আবেগপ্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা, মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জীভূত অভিমানে রূপ নেয়া এবং সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
প্রতিবেদন তুলে ধরে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, পিবিআইয়ের তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ৪৪ সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয়। পাশাপাশি ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়। এসব বিষয় পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, চিত্রনায়ক সালমান শাহ পারিবারিক কলহের জেরে আত্মহত্যা করেছেন। হত্যার অভিযোগের কোনো প্রমাণ মেলেনি।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন দাখিলের পরদিন ২৬ ফেব্রুয়ারি তা আদালতে উপস্থাপন করা হলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বাকী বিল্লাহ তাতে ‘দেখিলাম’ লিখে স্বাক্ষর করেন। একইসঙ্গে প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে ৩০ মার্চ শুনানির দিন ঠিক করেন। তবে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে সেই শুনানি পিছিয়ে যায়।
‘হত্যা নয়, আত্মহত্যাই করেছেন সালমান শাহ’ পিবিআইয়ের এমন প্রতিবেদন মানতে নারাজ বাদীপক্ষ। তাই এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দেওয়ার কথা বলে গত ৩১ আগস্ট সময় আবেদন করেন সালমান শাহ’র মায়ের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ।
আবেদনে বলা হয়, মামলার বাদী সালমান শাহ’র মা লন্ডনে অবস্থান করছেন। করোনা ভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে তিনি দেশে আসতে পারছেন না। তাই নারাজি দেওয়ার জন্য সময়ের আবেদন মঞ্জুর করা হোক।
সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ১১ অক্টোবর পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য করেন আদালত।
পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বাদীপক্ষ কেন সংক্ষুব্ধ জানতে চাইলে আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বাংলানিউজকে বলেন, সালমান শাহ’র মৃত্যুর ঘটনায় আমাদের কাছে যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল সব আদালতের মাধ্যমে আমরা পিবিআইকে সরবরাহ করেছি। এরপরও তদন্তে সেসব সাক্ষ্যপ্রমাণের প্রতিফলন ঘটেনি।
শুধু প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু নয়, প্রতিবেদনের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এ আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আইন অনুযায়ী তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে এজাহারকারীকে তদন্তের ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ (১) এর (খ) ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অপরাধ সংঘটন সম্পর্কে প্রথমে সংবাদ দিয়েছিলেন, সরকার নির্ধারিত উপায়ে তাকে নিজের গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত করবেন। ‘
এ আইনজীবীর দাবি সালমান শাহ’র ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘সালমানের মা নীলা চৌধুরীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। পিবিআইয়ের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে তাকে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে কিছু জানানো হয়নি। আইনজীবী হিসেবে আমিও কিছু জানি না। যেটুকু আমরা জেনেছি মিডিয়ার সংবাদ থেকেই। তাই এ প্রতিবেদন দাখিলের ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। ’
নারাজি দেওয়া হলে পরবর্তীতে কোনো ধরনের আইনি প্রক্রিয়ায় এ মামলা গড়াতে পারে? জানতে চাইলে আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, প্রথমত, যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে সাক্ষ্যপ্রমাণের যেটুকু পর্যালোচনা আছে সেই মর্মেই আদালত প্রতিবেদনটি আমলে নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত, আদালত অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দিতে পারেন অথবা ফের বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশও দিতে পারেন।
চলচ্চিত্রে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে থাকাকালে ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান চিত্রনায়ক চৌধুরী মোহাম্মদ শাহরিয়ার (ইমন) ওরফে সালমান শাহ। ওই ঘটনায় তখন অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী (প্রয়াত)। পরে ১৯৯৭ সালের ২৪ জুলাই ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ করে মামলাটিকে হত্যা মামলায় রূপান্তরিত করার আবেদন জানান তিনি। অপমৃত্যু মামলার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগের বিষয়টি একসঙ্গে তদন্ত করতে অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেন আদালত।
১৯৯৭ সালের ৩ নভেম্বর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় সিআইডি। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সালমান শাহের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। ২৫ নভেম্বর ঢাকার সিএমএম আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন গৃহীত হয়। সিআইডির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে তার বাবা কমরউদ্দিন আহমদ চৌধুরী রিভিশন মামলা দায়ের করেন।
২০০৩ সালের ১৯ মে মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে পাঠায় আদালত। এরপর প্রায় ১৫ বছর মামলাটি বিচার বিভাগীয় তদন্তে ছিল। ২০১৪ সালের ৩ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক বিকাশ কুমার সাহার কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের প্রতিবেদন দাখিল করেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক। এ প্রতিবেদনে সালমান শাহের মৃত্যুকে অপমৃত্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নীলা চৌধুরী ঢাকা মহানগর হাকিম জাহাঙ্গীর হোসেনের আদালতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে নারাজির আবেদন করেন।
এরপর মামলাটির তদন্তভার পড়ে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) কাছে। তবে র্যাবের দ্বারা তদন্তের আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল মহানগর দায়রা জজ আদালতে একটি রিভিশন মামলা করে। ২০১৬ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বিশেষ জজ ৬-এর বিচারক ইমরুল কায়েশ রাষ্ট্রপক্ষের রিভিশনটি মঞ্জুর করেন এবং র্যাবকে মামলাটি আর না তদন্ত করার আদেশ দেন। সেই থেকে প্রায় চার বছর তদন্ত করে পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল করে।
বাংলাদেশ সময়: ১০৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২০
কেআই/আরবি/