বরগুনা: বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে রাখা হয়েছে বরগুনা জেলা কারাগারের কনডেম সেলে। তাদের মধ্যে মহিলা ওয়ার্ডের একটি কনডেম সেলে রাখা হয়েছে নিহত রিফাতের স্ত্রী ও এ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে।
বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় দেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। এসময় মিন্নিসহ সব আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায়ের পরেই আদালত থেকে পৃথকভাবে দণ্ডপ্রাপ্তদের কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
বরগুনা জেলা কারাগারের কনডেম সেলে সদ্য ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এ ছয় আসামি ছাড়া অন্য কোনো কারাবন্দি নেই এমন তথ্যই নিশ্চিত করেছেন বরগুনা জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) মো. আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বরগুনার কারাগারে নারী বন্দিদের মধ্যে একমাত্র মিন্নিই কনডেম সেলে আছেন। মিন্নি ছাড়া বরগুনার কারাগারের কনডেম সেলে অন্য কোনো নারী বন্দি নেই। কারাবিধি অনুযায়ী মিন্নিকে কনডেম সেলে নির্ধারিত পোশাক, থালা, বাটি ও কম্বল দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া রিফাত হত্যা মামলার অপর পাঁচ আসামিকে কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। এ পাঁচজন বরগুনার কারাগারের কনডেম সেলে আর অন্য কোনো পুরুষ বন্দিও নেই।
তিনি আরও বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কারাগারের যে বিশেষ কক্ষে রাখা হয় সেটাকে কনডেম সেল বলা হয়। কনডেম সেলের বন্দিরা কখনও সেল থেকে বাহিরে বের হতে পারেন না। এসব বন্দিরা বিধি অনুযায়ী মাসে একবার স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এছাড়া সপ্তাহে একবার তারা ফোনে তাদের স্বজনদের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কথা বলতে পারেন।
রিফাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিই কনডেম সেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন জানিয়ে তিনি আরও বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী ছয় বন্দিকেই কনডেম সেলে থালা, বাটি ও কম্বল দেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রতি আসামিকে কারাগারের পক্ষ থেকে দুই সেট পোশাক দেওয়া হয়েছে।
মিনিসহ এ মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে দেশের অন্য কোন কারাগারে স্থানান্তরের পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে জেল সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, 'এ বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবো। আপাতত এ আসামিদের উচ্চ আদালতে আপিল করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। '
২০১৯ সালের ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজ রোডের ক্যালিক্স একাডেমির সামনে স্ত্রী মিন্নির সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর সহযোগীরা। গুরুতর অবস্থায় রিফাতকে উদ্ধার করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বরিশাল শেরে-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাত মারা যান। এরপর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে সাব্বির আহম্মেদ ওরফে নয়ন বন্ডকে প্রধান আসামি করে ১২ জনের নামোল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও পাঁচ/ছয়জনের বিরুদ্ধে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় প্রথমে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করেছিলেন নিহত রিফাতের বাবা। পরে ২ জুলাই ভোরে জেলা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নের পুরাকাটা ফেরিঘাট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রধান আসামি নয়ন বন্ড (২৫) নিহত হন। এ কারণে মামলা থেকে পরে তার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ বিষয়টি আমলে না নিলেও ফেসবুকে এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নড়েচড়ে বসে বরগুনার পুলিশ প্রশাসন। দেশব্যাপী ওঠে সমালোচনার ঝড়। এরপর চেকপোস্টে কড়া নিরাপত্তা ও তল্লাশিতে একে একে ধরা পড়েন অভিযুক্তরা।
হত্যাকাণ্ডের ২০ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই মিন্নিকে তার বাবার বাসা থেকে বরগুনা পুলিশলাইন্সে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ হত্যায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে মনে হওয়ায় ওইদিন রাতেই মিন্নিকে গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। পরে গত বছরের ১৭ জুলাই মিন্নিকে বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাতদিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে শুনানি শেষে আদালত মিন্নির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পরে গত বছরের ২০ জুলাই পাঁচদিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিন একই আদালতে রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম গাজী।
এরপর ৪৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার শর্তে উচ্চ আদালতের নির্দেশে বরগুনার কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হন মিন্নি। জামিনের পর থেকে বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় বাড়িতে ছিলেন তিনি।
মামলার তদন্তকারী সদর থানার কর্মকর্তা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি, তদন্ত) হুমাউন কবির ১ সেপ্টেম্বর ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্তবয়স্ক; দুইভাগে বিভক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জন রয়েছেন। মামলার চার্জশিটভুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক আসামি মো. মুসা এখনও পলাতক।
গত ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এরপর ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত। মোট ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে এ মামলায়।
রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলেন- রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি, আল কাইউম ওরফে রাব্বী আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়, মো. হাসান, মো. মুসা, আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি, রাফিউল ইসলাম রাব্বী, মো. সাগর এবং কামরুল ইসলাম সাইমুন।
এদিকে অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিরা হলো- হাজতে থাকা রিসান, রিফাত হাওলাদার, রায়হান, অলিউল্লাহ (অলি), নাঈম, তানভীর এবং জামিনে থাকা চন্দন, রাতুল, নাজমুল হাসান, নিয়ামত, মারুফ বিল্লাহ, মারুফ মল্লিক, আরিয়ান শ্রাবণ এবং প্রিন্স মোল্লা।
মঙ্গলবার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় শিশু আদালতে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আসামি পরীক্ষা করা হয়।
বুধবার বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। ফাঁসির রায়ের পাশাপাশি ছয় আসামিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। এ হত্যার ঘটনায় পুলিশ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলেও তার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার চলে এ আদালতে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০২০
ওএইচ/