কক্সবাজার: কক্সবাজারের বহুল আলোচিত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের এক বছর আজ। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের বাহারছড়ার শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
আলোচিত এ হত্যা মামলার চার্জ গঠন শেষে আদালত গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেছিল। কিন্তু চলমান কঠোর লকডাউনের কারণে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
তবে দেশের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর লকডাউন তুলে নেওয়া হলে দ্রুত এ মামলার বিচারকাজ শুরু করা হবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন এ মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. মোস্তফা।
তিনি বলেন, মামলাটি যেভাবে চলছে, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মামলার কার্যক্রম নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। এখন বাঁধা শুধু লকডাউন।
২০২০ সালে ৩১ জুলাই। টেকনাফের সেই টুইন্যা পাহাড়। মেরিন ড্রাইভের পাশে অবস্থিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের এই পাহাড়ে ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য ভিডিও চিত্র ধারনের কাজ শেষ করে হিমছড়ির নিলীমা রিসোর্টে ফিরছিলেন মেজর সিনহাসহ তার তিন সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও তাহসিন রিফাত নূর।
সময় তখন রাত সাড়ে ৯টা। সিনহা এবং তার সহযোগীরা শামলাপুর চেকপোস্টে পৌঁছালে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় পুলিশ।
এ হত্যাকাণ্ডের দুই দিন পর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। কমিটি সরেজমিনে তদন্ত করে ঘটনার কারণ ও উৎস অনুসন্ধানের প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ জমা দেয়।
এর পর হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিন পর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ নয়জনকে আসামি করে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হত্যা মামলা করেন। মামলার পরদিন ৬ আগস্ট প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
আদালত এ মামলাটির তদন্তভার দেন র্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ান র্যাব-১৫ কে। র্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. খায়রুল ইসলামকে মামলা তদন্ত কাজ শেষ করে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে পরিকল্পিত ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মামলার এজাহারভুক্ত নয়জন থাকলেও পরবর্তীতে তদন্তে সংশ্লিষ্ঠতার বিষয়টি ওঠে আসায় পুলিশের করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে দায়িত্বরত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়।
মামলায় অভিযুক্ত ১৫ জনের মধ্যে জন ১৪ আসামিকে র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তা বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
চার মাস তদন্ত শেষে ১৩ ডিসেম্বর ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ২০২১ সালের ২৪ জুন আত্মসমর্পণ করেন এই মামলার একমাত্র পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব। চলতি বছরের ২৭ জুন মামলায় অভিযুক্ত ওসি প্রদীপসহ ১৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠনপূর্বক সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন আদালত।
মামলায় অভিযোগপত্রে থাকা ১৫ জন আসামি বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এরা হলেন- টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুল করিম, সাগর দেব, রুবেল শর্মা, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আবদুল্লাহ এবং পুলিশের করা মামলার সাক্ষী এ মামলার আসামি টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
চলতি বছরের ২৭ জুন সব আসামির উপস্থিতিতে মামলার অভিযোগ গঠন করেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। এর আগে মামলা তদন্তকালীন কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ও কনস্টেবলসহ এক হাজার ৫০৫ পুলিশকে বদলি করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে সারাদেশের মতো কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম না চলায় নির্ধারিত দিনে মেজর সিনহা হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
বাদী পক্ষের আইনজীবী মো. আব্দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, এ মামলার সাক্ষী ৮৩ জন। সেখান থেকে ১৫ জনকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এবং ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্যগ্রহণের ধার্য্য দিন ছিল। কিন্তু কঠোর লকডাউনের কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়নি। দেশের পরিস্থিতি স্বভাবিক হলে মামলার নিয়মে মামলার কার্যক্রম চলবে।
অভিযোগপত্রে যা আছে-
র্যাবের দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের ৭ জুলাই মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান, সহকর্মী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও রুফতি কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউবে একটি ভিডিও চ্যানেল নিয়ে কাজ করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মিদশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহাকে জানান। নীলিমা রিসোর্ট থেকে টেকনাফে রওনা হন সিনহা ও সহকর্মী সিফাত। সন্ধ্যায় সিনহা মারিশবুনিয়া গ্রামের টুইন্যা পাহাড়ে গেলে একটি মসজিদ থেকে মাইকেএলাকায় ডাকাত ঢুকেছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়।
ঘোষণার নেপথ্যে ছিলেন স্থানীয় আয়াজ উদ্দিন ও নুরুল আমিন। তারা পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচিত। ওই দিন সকাল থেকে সিনহার গতিবিধি নজরে রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বৃক্ষরোপণ অনুষ্ঠানে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা প্রাইভেটকার নিয়ে শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে সিনহার প্রতি নজর রাখেন পরিদর্শক লিয়াকত আলী।
শামলাপুর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে সিনহাকে চারটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। কিছুক্ষণ পর ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে যান, তখনও সিনহা জীবিত ছিলেন। এ সময় ওসি প্রদীপ সিনহার মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পা দিয়ে আঘাত করেন। এরপর সিনহার মৃত্যু হয়। পরে তাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে, সিনহা হত্যা মামলাটি বেআইনি ও অবৈধ দাবি করে ৪ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি লিয়াকতের আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। কিন্তু ওই মামলার বিশেষ কোনো অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২১
এসবি/এএটি