ঢাকা: করোনা মহামারিতে কেটে গেল আরও একটি বছর। চলতি বছরে শারীরিক ও ভার্চ্যুয়ালি দুই মাধ্যমে চলেছে উচ্চ আদালতের বিচার কাজ।
আগামী ২০২২ সালে নতুন বছরে সুপ্রিম কোর্টে কয়েকটি আলোচিত মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে আপিল বিভাগে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় রিভিউ চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি এবং জাপানি মা ও বাংলাদেশি বাবার দুই সন্তানের জিম্মা নিয়ে শুনানি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়া হাইকোর্ট বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে ফেনীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) ও আসামিদের আপিল এবং জেল আপিল। যে মামলায় ১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়েছে।
ষোড়শ সংশোধনী
২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে এ রিট আবেদন দায়ের করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে একই বছরের ৯ নভেম্বর এ সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
২০১৫ সালের ২১ মে রুলের শুনানি শুরু হয়।
পরে ২০১৬ সালের রুলের শুনানি শেষে ৫ মে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করেন।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে সর্বসম্মতিক্রমে চূড়ান্ত রায়টি দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলও খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।
ফলে মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়।
এরপর একই বছরের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়। পরে এ রায় পুর্নবিচবেচনা চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
জাপান থেকে আসা দুই শিশু
২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাদের ১২ বছরের সংসারে তিনজন সন্তান জন্ম নেয়।
তারা হলো- জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী এরিকোর সঙ্গে ডিভোর্স আবেদন করেন। পরে ইমরান দুই সন্তান নিয়ে দেশে চলে আসেন। এরপর এরিকো বাংলাদেশে এসে হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট দুই মেয়েকে বাবার হেফাজতে দিয়ে দেন। তবে মা দেখা-সাক্ষাৎ এবং একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন। যেহেতু মা জাপানি নাগরিক এবং সেখানে বসবাস ও কর্মরত আছেন সেই কারণে তিনি তার সুবিধা মতো সময়ে বাংলাদেশে এসে শিশুদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন সময় কাটাতে পারবেন। এক্ষেত্রে বছরে তিনবার বাংলাদেশে যাওয়া-আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের সব ধরনের খরচ ইমরান শরীফকে বহন করতে বলেন। এর বাইরে যাওয়া-আসার খরচ মা বহন করবেন এবং ছুটির দিনে অন্তত দুবার শিশুদের সঙ্গে ভিডিওকলে মাকে কথা বলিয়ে দেবেন ইমরান শরীফ। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত খরচ বাবদ আগামী সাত দিনের মধ্যে পাঁচ নম্বর বিবাদী দরখাস্তকারীকে ১০ লাখ টাকা দেবেন।
কিন্তু এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে যান মা নাকানো এরিকো। আপিল বিভাগ গত ১৫ ডিসেম্বর শুনানি ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করে দুই মেয়েকে সেই পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় দেন।
নুসরাত হত্যা
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাতকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন তার মা শিরীন আখতার। এ মামলার জের ধরে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা চালায় তারা।
ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হওয়ায় সেখান থেকে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল মারা যায় নুসরাত।
এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় বিচার শেষে একই বছরের ২৪ অক্টোবর রায়ে ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলা (৫৭), নূর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসার সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), মহিউদ্দিন শাকিল (২০) ও মোহাম্মদ শামীম (২০)।
২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছে।
এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। পরে প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি শুনানির জন্য হাইকোর্ট বেঞ্চ নির্ধারণ করেন।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে সে রায় অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এছাড়া আসামিরা জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিল করেছেন।
এখন ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন) ও আসামিদের আপিল এবং জেল আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০২১
ইএস/আরবি