পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত চুপটি করে থেকে বাবু এক বৈশাখের দুপুরে দশটি কথা বললো, এমন অনায়াস ভঙ্গিতে যেন কথা বলা না বলা নিতান্তই মামুলি ব্যাপার। মায়ের তো পিলে চমকে গেল।
রাজশাহীর বৈশাখের দুপুর মানে ঝাঁঝালো রোদ। স্নাতকোত্তর শেষ পরীক্ষাটি দিয়ে তেতেপুড়ে ক্লান্ত মা ঘরে ঢুকে ব্যাগটা একদিকে ছুঁড়ে দিতে দিতে বাবু এসিটা দাও তো বলে বিছানায় ধপাস।
বাবু হেলেদুলে সুইচের দিকে যাচ্ছে, আর অন করতে করতে বলছে ‘এসিইই’।
আচ্ছা। মা কোলবালিশটা জড়িয়ে পাশ ফিরতে গিয়ে লাফিয়ে উঠে বসলো, কি বললে ওটা কি বাবু ...এসি।
এটা বালিশ।
মাথার ওপর ওটা ফ্যাএএন।
বলো কি! আর ঝুড়িতে এটা
আআপিইল! (আপেল)
দশটি কথা মানে দশটি শব্দ। কিন্তু প্রতিটি শব্দ হাজার শব্দের প্রতিধ্বনি করছে তখন ঝাউতলার সেই মা-ছেলের শোবার ঘরের চারদেয়ালে। বাসার সামনে সাদা ফুলে ভরা সজনে বাগান,পেছনের কলাগাছ ঘেরা বিশাল পুকুর,অসংখ্য মাছরাঙার নীল ডানা,খোলা বারান্দা আর ছাদ ছাড়িয়ে দশটি শব্দ ইথারের তরঙ্গে ভেসে ভেসে কোথায় না ছড়িয়ে গেল।
বাগানবিলাস, অলকানন্দা, সোনালু, জারুল আর প্রাচীন বট কড়ইয়ে ছাওয়া গ্রেটার রোড, মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণ, চিড়িয়াখানার ভালুকের খাঁচা আর সার্কিট হাউজের ধার ঘেঁষে পদ্মার পাড়--এতোদিন যত কোলাহলমুখর জায়গায় গেছে বাবু, সবাইকে শোনাতে আকুল হলো মায়ের মন। বাবু কথা বলেছে।
দিন যায়,বাবুর শব্দভাণ্ডারে একটি দুটি করে নতুন শব্দ যোগ হয়। মায়ের বাংলা ভাষায় যেমন ভাগ আছে তদ্ভব, তৎসম,দেশি, বিদেশি নানারকম শব্দ, বাবুরও তেমনি কোনোটি একদম মায়ের মতো বলা শব্দ, কোনোটি কিছু পরিবর্তিত এবং কোনোটি একেবারেই বাবুর নিজস্ব,যেটি বুঝতে চাইলে মাকে মোর্স কোড জানতে হবে।
সেই কবে থেকে মা বাবুর জন্য বই কিনবে ভেবে লিস্ট বানায়, শেষ পর্যন্ত দু্ই-একটা কেনা হয়। ভয় হয় বই নিয়ে বেশি জোরাজোরি করলে বাবু যদি বিরক্ত হয়! কারণ যার সঙ্গে বাবুর দেখা হয় সে-ই তাকে কথা বলানোর চেষ্টা করে। এবার তো মাকে আর পায় কে কিন্তু বই নির্বাচনের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, অক্ষরগুলো বড়ো বড়ো হতে হবে, ছবি থাকবে প্রায় পুরো পাতা জুড়ে, একটুখানি লেখা। আর বইটিতে সহজ ভাষায় ছোট্ট একটি গল্প থাকবে। এমন বই তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। পরিচিতদের মা জানিয়ে দিল এরকম বইয়ের সন্ধান করতে। পাতাবাহার নামে একটি প্রকাশনীর খবর এলো যাদের এ ধরনের বই আছে। তবে গল্প হিসেবে নয়, বাংলা বর্ণমালা, ইংরেজি অ্যালফাবেটস ক্যাপিটাল এবং স্মল, অঙ্ক ইত্যাদিতে হাতে খড়ির জন্য।
সৌরভ (বাবুর খালাতো ভাই) ঢাকা থেকে এসব জানালো। আগামী বছর বইমেলায় পাওয়া যাবে, তার আগে নয়। টিভি চ্যানেলগুলোর নামও বলে এখন বাবু। এটিএন, চ্যানেল আই, দেশটিভি, বাংলাভিশন, ডিসকভারি। একটা মজার ব্যাপারও হলো, ইন্ডিয়ার আকাশ টিভিতে প্রতিদিন সকালের একটি অনুষ্ঠান গুড মর্নিং আকাশ; বাবু সেটা এমনভাবে আত্মস্থ করলো যে এখনো কাউকে গুড মর্নিং বলতে চাইলে গুড মর্নিং আকাশ বলে। গান শুনতে খুব ভালোবাসে। এরই মাঝে একদিন মা শুনতে পেল বাবু আপন মনে গাইছে, লিরিকস বোঝা যায় না। রাজশাহীতে বছর দুই ছিল তারা, সে ততোদিন ওই একটি গানই গায়। এটার গীতিকার, সুরকার বাবু, ভাষাও তার--
আনু না না,
ইমি না না,
ওহ্ টিস টিস!
কিছুদিন পর আরেকটি --
আজিয়া পা পা
চুঁ চুঁ চুঁ
ইউবি বিয়াবি আচু বিশ!
সেই ছয় সাত বছর বয়সের গান। গত দশ বছর ধরে অবিকল রেখে বাবু গেয়ে চলেছে, কিন্তু এর মধ্যে সে স্কুলে মিউজিক ক্লাসে অনেক গান শিখেছে। আমরা সবাই রাজা,ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে,পাগলা হাওয়ায় বাদল দিনে,পুরানো সেই দিনের কথা, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে অথবা মাগো, ভাবনা কেন, পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে। সব গান কিছু অস্পষ্ট উচ্চারণে, কিছু যথাযথভাবে সে গাইতে পারে।
দুটি শব্দে ছোট ছোট কথা বলে, তবে যত আলসেমি তার কথা বলাতেই। হাসিখুশি থাকলে এক টুকরো গল্পও হয়তো শোনায়। মা কথা শোনার লোভে সারাক্ষণ বাবুকে খুশি করতে চায়।
ঝাল চানাচুর পেলে আর কিছু চাই না বাবুর। মাছের ডিম, করলা ভাজি, আলুভর্তা, শিম খুব পছন্দের। কম্মা (কমলালেবু), বাতা লিবু (বাতাবি লেবু), লিচু তার প্রিয়। পড়াশোনা,ব্যায়াম বা কোনো কঠিন কাজ করাতে চাইলে পুরস্কার হিসেবে পছন্দের কিছু অবশ্যই দিতে হবে।
সেবার স্কুলের পিকনিকে কোনো বন্ধুর বাবা মা দুজনেই গিয়েছে, কারুর শুধু মা। বাবুর সবচেয়ে প্রিয় সামি বন্ধু। এবার সে বাবার সঙ্গে এসেছে, মা আসেননি। বাবু সামির বাবার নড়াচড়া, কথা বলা, আর যত কাণ্ডকারখানা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। আর আপনমনে হেসে হেসে ছোট্ট ছোট্ট হাততালি দিল। এতোদিন পরে মায়ের মনটা কেমন করতে লাগল, বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হলো মা। বাবা যখন দূরে চলে যায়, বাবু তখন চার বছরের। মা যেন ভুলেই গেছে বাবাকে যে পাওয়া হলো না প্রায় বছর সাতেক। আজ মনে হলো, তাই তো, বাবু কাঁধে চড়ে দুই পা ঝুলিয়ে ঘুরতে খুব পছন্দ করে। ( মা এখন কাঁধে নিতে পারে না, বাবু বড় হচ্ছে, ওজন বেড়েছে)। বাবা প্রায়শই তাকে কাঁধে নিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াতো।
পুরো পিকনিক জুড়ে শুধু একটি কথা মায়ের মনে এলো, বাবা এনে দিলে কেমন হয়,বাবু খুব খুশি হবে। এবারের জন্মদিনে গল্প বলবে -এক যে আছে লাজা (রাজা), লানী আর লাজপুত্র!
তারপর, মা রুপোর কাঠি খুঁজতে শুরু করে, প্রায় মহেঞ্জোদারো যুগে বন্ধ হয়ে যাওয়া মনের দরজা খুলতে হবে তো! নতুন বাবা শুধু বাবুর কাছেই আসবে না,মায়ের জন্যও তো খোলা আকাশের নীল, চাঁদের আলোয় ঘুমন্ত চরাচর, চৈত্রের বাতাসে ভাসা লেবু ফুলের ঘ্রাণ কিংবা পৃথিবীর সব রূপ লেগে থাকা ঘাস যে সে!
মা ভাবে, কত কতদিন তার নিশ্চিন্ত মনে কয়েকটি মুহূর্তও বসা হয়নি। ‘কিচ্ছু জানি না’ বলে রূপসি বাংলা বা আরণ্যক বইটি ব্যাগে ভরে কোথাও কোনো গাছগাছালির ছায়ায় গিয়ে একপাতা পড়ে নেওয়া হয়নি।
বন্ধুজনেরা আতিপাতি করে আনে দু-তিনটে নাম-ধাম। প্রথম জন পুলিশের বড়ো কর্মকর্তা। তার দুটি ছেলে আর অনেক অনেক সম্পদ, খান কতক বাড়িও আছে। মায়ের ভয় হয়, এরপর তো প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়তে হবে। ও বাড়ির সবাই ভাববে, বাবু আর মা মিলে ধনসম্পদ দখল করে ফেললো বুঝি। থাক তাহলে।
দ্বিতীয় জন ষাট বছরের শিশু বিশেষজ্ঞ। স্ত্রী মারা গেছেন। বাবুকে খুব বুঝবে এবং চিকিৎসা নিয়েও আর ভাবতে হবে না। মা খানিকটা আশ্বস্ত হয়। কর্মসূত্রে অন্য কলিগদের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় বার কতক তাকে দেখার সুযোগ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বন্ধুদেরকে বলছেন, ‘পাত্রী হতে হবে কমবয়সী।
মাতৃমনি ডটকম থেকে তৃতীয় জনের নাম এলো। সে ব্যাংকার,অবিবাহিত। অটিস্টিক কিশোর এবং মধ্যবয়সী মাকে নিয়ে পরিবার গঠনে আগ্রহী। মা তো হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। ব্যাংকার জানালো স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অবদান রাখার এক বিশাল পরিকল্পনা আছে তার, ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার প্রতিষ্ঠা করবে সে।
‘এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে ’! বাবা হওয়াটা তার কাছে নিছকই ইনভেস্টমেন্ট।
এমনি করে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হয়ে যায় কিংবা ঠগ বাছতে গাঁ।
দিন যায়....
জন্মদিন চলে আসে, প্রতি বছরের মতো এবারও স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে কেক কেটে আর বেলুন উড়িয়ে বাবু ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’ গায়।
বাবুদের নীল রঙের পৃথিবীতে কেউ কাউকে প্রশ্ন করার নিয়ম নেই। তাইতো মাকেও বাবু প্রশ্ন করেনি, ‘জন্মদিনের সবচেয়ে সুন্দর গিফটের প্যাকেটটি কোথায় রেখেছ মা’?
লেখক: পরিচিতি
ডা.শাহনাজ পারভীন
সহযোগী অধ্যাপক, প্যাথলজি
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২৪
এসআইএস