ঢাকা, সোমবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৯ জুলাই ২০২৪, ২২ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

সাধ ও সাধ্য

মনোয়ারুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১২
সাধ ও সাধ্য

মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তে পরিবারের মানুষরা সব সময় কেনাকাটায় সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে করতে হিমশিম খান। ঈদে এই অবস্থা আরও প্রকট আকার ধারণ করে।

ঈদে পরিবারের সদস্যদের কাপড়-চোপড়, শখের কোন আবদার, অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য কেনা, আতিথেয়েতা, যানবাহন খরচ সব মিলিয়ে বেশ কিছু অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়। রাজধানীর বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে বিক্রেতা, ক্রেতা ও পথচারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের সংকটের কথা।

চাকুরীজীবীদের অতিরিক্ত আয় বলতে শুধূ ঈদ বোনাস। তারপর ঈদের জন্য অতিরিক্ত কাজের চাপ। অনেক প্রতিষ্ঠান ঈদ বোনাস দেয়না। অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতনই বকেয়া তাই ঈদ বোনাস স্বপ্নের মতো।  

ব্যবসায়ীদের বিক্রি বাড়লেও দোকানের অতিরিক্ত ব্যয়, সাজসজ্জা, ঈদ চাঁদাবাজি, কর্মচারীদের অতিরিক্ত টাকা দিতে গিয়ে সবাই একটা বাড়তি চাপ সামাল দিচ্ছেন।

শুধুতো ঈদের কেনাকাটা নয়। কেনাকাটা ছাড়াও কারো ঈদের আগে সব ধরনের বিল পরিশোধ করার চাপ, বাড়িভাড়া, টিউশনির টাকা, ঋণ পরিশোধের চিন্তা, গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানোর চিন্তা, আত্নীয় স্বজনকে অ্যাপায়ণ, আত্মীয়দের উপহার, এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, মাঠের টাকাসহ নানা প্রথা সামলানো। শুধু তাই নয় ঈদের পর সন্তানদের কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলের বেতন আরও কত চাহিদা। খরচের অংক বাড়লেও আয়তো সেভাবে বড়েনা।  

জীবনধারণে খাদ্যপণ্য, খাদ্যবহির্ভূত পণ্য, বাড়িভাড়া, বিদ্যুত্ বিল, পরিবহন ভাড়া, চিকিত্সা ব্যয়, শিক্ষা ব্যয়সহ অন্যান্য ব্যয় দফায় দফায় বেড়ে যাওয়ায় অনেক পরিবার দিশেহারা। পাশাপাশি অন্যান্য সেবার বিল বেড়েছে। সব মিলয়ে  প্রচণ্ড আর্থিক চাপে পড়েছে মানুষ। সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর জোগান দিতেই হিমশিম । নিত্যপণ্যের তালিকা কাটছাঁট করে চলছে সংসার। বিলাসী জিনিসপত্র কেনাও স্বপ্নের মতো। আয়ের টাকা দিয়ে খাদ্যের জোগান, বাড়িভাড়া, সংসারের প্রয়োজনীয় পণ্য না ঈদ কেনাকাটা করবেন।  হিসাব কষতে কষতে গলদঘর্ম মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো।

প্রতিবছরই রমজান থেকে ঈদের আগে নিত্যপ্রযোজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে বেড়েছে পরিবহন খরচ তারপরেও পাবলিক বাসের সংকট।   মূল্যস্ফীতির ফলে টাকার মূল্যও কমে গেছে। কিছুদিন আগে শেয়ারবাজার ধ্বসের ফলে অনেকই নি:স্ব হয়েছে। সব মিলিয়ে জীবনযাপন কঠিন আকার ধারণ করছে।

আলোক ঝলমলে মার্কেটে, সাজানো দোকানে নানা পণ্য সাজানো জানো আছে থরে থরে। কিন্তু ক্রেতার সামর্থ্য নেই সেসব স্পর্শ করার। সব পণ্য সবার জন্য নয় ভেবে অনেকই হয়তো নিজেকে সান্তনা দিচ্ছেন।

২০১২ সালের বাজেটে আমদানি করা পোশাকের ওপর শতকরা ৩১ ভাগ করারোপ করায় পোশাকের দাম বেড়েছে। পাইকারি দোকানে বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, মার্কেটের ঈদ আয়োজনের খরচ, খুচরা বিক্রেতার দাম বৃদ্ধি সব অতিরিক্ত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

তবে, পোশাকের দাম বাড়লেও বিত্তবানদের তেমন কোনো সমস্যাই হচ্ছে না। তারা রমজানের শুরু থেকেই দফায় দফায় মার্কেটে গেছেন এবং পছন্দের পোশাক, প্রসাধনী এবং অংলকার কিনেছেন।

মার্কেটে গিয়ে পরিবারের সদস্য, বাবা-মা,  স্ত্রী, আদরের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি ন্যূনতম  কেনাকাটাও সবার জন্য সহজ নয়। অনেকেই নিজের জন্য কিছুই না কিনে শুধু প্রিয়জনদের খুশি করার জন্য সাধ্যমত কেনাকাটা করছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ মার্কেটে আসলেও সেই অনুপাতে বিক্রি হচ্ছে না। অনেককেই সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় ঘটতে না পেরে এক দোকান থেকে অন্য দোকানে ঘোরাফেরা করেন।  আবার গতবার যিনি পরিবারের সবার জন্য ১২ টি পোশাক কিনেছেন, এবার কিনছেন ৬ টি। এভাবেই ক্রেতারা তাদের বাজেট সমন্বয় করছেন। তবে বাচ্চাদের পোশাক কিনতেই দোকানগুলোতে বেশি ভিড়।

নিউমার্কেটের বিলকিস ফ্যাশন হাউজের মালিক আবদুল কাহহার বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ সাধ্য অনুযায়ি সব কিনতে পারে না। অনেকেই দাম আগে বলেন তারপর কাপড় দেখছেন। তবে যে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে তাতে আমরা খুশি। কারণ, ঢাকা শহরে এখন  কোটি লোক বাস করেন। সবারই যদি চাহিদা অনুযায়ী কেনার সামর্থ্য থাকত তাহলে আমাদের দোকান শূন্য হয়ে যেত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদ্দিন হলের ছাত্র নাঈম বলেন, আমার আয় বলতে টিউশনি। এই টাকা থেকে নিজের পড়াশোনা, বোনের পড়াশোনা চালাই। ঈদে গ্রামে পরিবারের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য কাপড় আর বোনের জন্য থ্রিপিস নিয়েছি। নিজের কিছু কেনা হয়নি। কারন আমার গ্রামে যাতায়াত খরচ আছে। ঈদের পর ঢাকা এসে চলতে হবে। জিনিপত্রের সবকিছুর দাম বেড়েছে। ঈদের কেনাকাটা হবেনা। তবুতো ভালোভাবে খেতে পারবো। অনেকই তো একবেলা খাবারও পায়না।

সমাজের বৈষম্যের জন্য দু:খ করে তিনি বলেন, ঢাকার বড় বড় মার্কেটের কেনাকাটা। ডায়মন্ড ও স্বর্ণের গহনার বিজ্ঞাপন আমাদের জন্য নয়। আমাদের ঈদের একমাত্র আনন্দ পরিবারের সাথে সময় কাটানো।

বুয়েটের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আউয়াল শেখ বলেন, নিজের জন্য কিছু না হোক সন্তানদের জন্য কিছু কিনতে পারলে ভালো লাগে। কষ্ট আর অপারগতার গ্লানী নিয়ে কখনো সন্তানের সামনে দাড়াতে কষ্ট হয়।

খিলক্ষেতের একটি বেসরকারি কেজি স্কুলের শিক্ষিকা আমেনা বেগম বাংলানিউজকে বলেন, এখনো বেতন বোনাস পাইনাই। তাই মার্কেটে গিয়ে বাচ্চাদের শুধূ দেখে এনেছি। বেতন পেলে বাচ্চাদের জন্য কাপড় কিনবো।

ঈদ আয়োজনের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে কেনাকাটা। কিন্তু সাধ এবং সাধ্যের সমন্বয় করে চলতে হবে আমাদের। আর ঈদের আনন্দ সবার জন্য এখানে শুধু  টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর না করে দেশি ভালো পণ্য বেছে নিন।

সামর্থবানদের প্রতি অনুরোধ, অপ্রয়োজনে অনেক কেনাকাটা করার সময় গরীব আত্মীয় অার রাস্তায় ফেরি করে বেড়ানো শিশুগুলোর দিকে একটু নজর দিতে।  

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।