ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

ভালো দোসর

আনিসুর রহমান বুলবুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৩
ভালো দোসর

ওকে প্রথম দেখি নৌকার ছোইয়ের ওপর। ওরা কয়েক জন বসে গল্প করছে।

আমি প্রিন্স আর রবিও নৌকার ছোইয়ের ওপরই বসে আছি। প্রিন্সরা প্রতিভা কোচিং সেন্টারের সকল ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে শিক্ষা সফরে যাচ্ছে। আমি গেস্ট হিসেবে যাচ্ছি। বেউথার নৌকা ঘাট থেকে সকালে গিয়ে নৌকায় উঠলাম। নৌকা ছেড়ে দিলো। একবার দুবার ওর চোখে আমার চোখ পড়ে। রৌদ্র বেড়ে যাওয়ায় আমরা নিচে গিয়ে বসলাম।

নৌকা তরা ব্রিজ পার হয়ে সাটুরিয়ার দিকে চলছে। ওরাও নিচে এসে বসলো। আমি ছোইয়ের খুটির সাথে হেলান দিয়ে বসে আছি। প্রথম দেখায় ভালো লাগা কথাটি নিয়ে খুব ভাবছি। মেয়েটি তার চুল খুলে দিলো। বাতাসে খোলা চুলের ছড়াছড়ি খুব উপভোগ করছিলাম। জানি না কেনো যেনো আমার নজর অন্য কারো দিকে যাচ্ছিলো না!

দেখলাম ব্যাগ থেকে ছোট্ট একটা আয়না বের করে কপালে কালো রংয়ের টিপ লাগালো। আহ্ কী যে সে দৃশ্য! মনটা হারিয়ে যাচ্ছে বারবার অজানায়। কেনো যেনো টিপটি মেয়েটি খুলে ফেললো। আমার মনে মনে রাগ হলো। আমি যে ওকে লক্ষ্য করছি সেটা মেয়েটিও মনে হয় দেখছে। আমার দিকে তাকাতেই হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বুঝালাম। টিপটি কপালে লাগাও। দারুণ লাগছে তোমায়! মেয়েটিও আমার কথা মতো কপালে টিপ লাগালো।

নৌকার মধ্যের সবাই প্রতিভা কোচিং সেন্টারের ছাত্রছাত্রী আর কয়েকজন শিক্ষক। শুধু আমিই বাইরে থেকে যাওয়া গেস্ট। প্রিন্স রবি ছাড়া আর কাউকে তেমন চিনি না। সবাই হৈহুল্লোড় করছে। মাইকে গান বাজছে, ছবি তুলছে। আমি তাকিয়ে আছি নদীর দিকে, নদীর পাশের গ্রামের দিকে, তাকিয়ে দেখছি আমার সামনে বসা সেই মেয়েটিকেও।

দেখলাম কবি মহাদেব সাহার একটি বই ব্যাগ থেকে বের করে মেয়েটি পড়ছে। আমি আর হেলান দিয়ে থাকতে পারলাম না। মহাদেব সাহার বই বলে কথা! আমার প্রিয় কবির অন্যতম মহাদেব সাহা। আমি বইটি চাইলাম। মেয়েটিও বইটি দিলো আমাকে। আমি মহাদেব সাহার কবিতা সমগ্র বইটির পাতা খুলে খুলে দেখছি আর ভাবছি কীভাবে মেরে দেয়া যায়! বললাম-

- বইটি পড়ার জন্য কয়েক দিনের জন্য আমাকে দেবে?

- নিতে পারেন তবে ফেরত দিতে হবে। কলেজের লাইব্রেরী থেকে নেয়া!

কথা বলার একটা দারুন সুযোগ হলো বইটিকে কেন্দ্র করে। মনে মনে এই সুযোগটিই চাচ্ছিলাম। বল্লাম-

- আমি কবি মহাদেব সাহার সিরিয়াস ভক্ত!

- আমিও!

- বাহ, দারুণ তো মিলে গেলো! আচ্ছা তুমি কোথায় পড়ো?

- মহিলা কলেজে, সেকেন্ড ইয়ারে।

- তোমার নাম?

- বৃষ্টি

- সুন্দর নাম! ছোট্ট একটা শব্দ। তবে পুরো একটা স্লোগান!

- মানিকগঞ্জের থাকো কোথায়?

- মহিলা কলেজের হোস্টেলে থাকি।

- ওহ। তাহলে তো থাকা খাওয়া খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না!

- তাতো কিছুটা হচ্ছেই!

- তোমাদের বাড়ি কোথায়?

- সিংগাইরে।

- ওহ। তাইলে তো বাড়ি থেকেও ক্লাস করতে পারছো না।

আমাদের কথা আস্তে আস্তে সামনে এগুতে থাকে। বৃষ্টির কোনটা প্রিয়, কোনটা অপ্রিয়। আমার কোটনটা প্রিয়, কোনটা অপ্রিয়। বৃষ্টির বাবা আর্মির রিটায়ার্ট মেজর। আমি আমারও পরিচয় দিলাম।

বালিয়াটি জমিদার বাড়িতে সারাদিন থেকে আবার সবাই নৌকায় এসে উঠলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। নৌকার ছোইয়ের ওপরে বসে আছি সবাই। একদিনের পরিচয়ে ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে বৃষ্টির সাথে। গোধুলী লগ্নে বৃষ্টিকে খুবই ভালো লাগছিলো। লোভটা সামলাতে না পেরে প্রিন্সের কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে একটি ছবি তুললাম। ছবির ক্যানভাসের সাথে বৃষ্টির কম্বিনেশন জটিল লাগছিলো। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হলো র‍্যাফেল ড্র হবে। র‍্যাফেল ড্রতে প্রিন্স একটা ডাইরী পেলো। সময়টা খুব ভালো কাটছিলো। দেখতে দেখতে নৌকা বেউথার ঘাটে চলে এসেছে। সময়ের সাথে খুব হিংসে হচ্ছিলো। সময় কেনো এতো কিপটে হলো! চলে আসার সময় বৃষ্টি আমার মোবাইল নম্বর চাইলো। প্রিন্সের সেই ডাইরীর একটি পাতা ছিড়ে মোবাইল নম্বরটা লিখতে গেলাম। কেনো যেনো মনের মধ্যে দুষ্টুমি বুদ্ধি হলো। ইচ্ছে হলো বৃষ্টির আরো সান্নিধ্য পেতে। মোবাইল নম্বরের আগে আরো তিনটা লাইন যোগ করলাম-

- বৃষ্টি, বন্ধু হবে আমার? খুব ভালো বন্ধু!

আমার অভ্যাস হলো যে যে লাইনটা ভালো লাগে সেটা আন্ডার লাইন করে ফেলি। বৃষ্টির কাছ থেকে নিয়ে আসা মহাদেব সাহার সেই বইটিতেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ক্যাম্পাসে ফিরে এলেও লেখাপড়ায় মন বসছে না। মহাদেব সাহার বইটি পড়ছি। হঠাৎ মোবাইলে ফোন আসলো আন-নন নম্বর থেকে। কলটি রিসিভ করলাম।

- হ্যালো কে বলছিলেন?

- জি আমি বৃষ্টি!

- বৃষ্টি! ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। তোমার সেই বইটাই পড়ছিলাম।

- তাই!

- হ্যাঁ। আচ্ছা তুমি কার নম্বর থেকে ফোন দিয়েছো?

- কলেজ গেইটের ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে

- ও। বলো কি বলবে?

- নাহ। এমনিতেই। দেখলাম ভূয়া নম্বর দিয়েছেন কিনা!

- কী যে বলো না! আমাকে দেখে কি তোমার তাই মনে হয়েছে?

- না। আসলে!

- ঠিক আছে। থাক আর আমতা আমতা করতে হবে না। তোমার সাথে দেখা হবে কি?

- হুম। হতে পারে!

- তার মানে আমাকে বন্ধু মেনে নিচ্ছো!

- সেটা কী আর বলতে হচ্ছে!

- তোমার বইটি নেওয়ার জন্যও তো ফোন দিতে পারো!

- না আসলে তা নয়!

- তুমি আজ দেখা করতে পারবে?

- হুম। পারবো। তবে বিকেল তিনটায় আসতে পারবেন?

- কোথায়?

- ভাবনা ফাস্টফুডে

- ঠিক আছে।

মোবাইলটা রেখে দিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা এগারটা বেজে গেছে। ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ যেতে সময় লাগবে সব মিলিয়ে ঘন্টা দুয়েক। দ্রুত রেডি হয়ে রওয়ানা দিলাম। আমি জানি না কেনো যেনো বৃষ্টির সাথে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করছিলো। ওর সাথে সেই একদিনের পরিচয়। তারপরেও কেনো যেনো মনে হচ্ছে ওর সাথে আমার জনম জনমের পরিচয়! মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিক্সা নিলাম। ভাবনা ফাস্টফুডে গিয়ে বসে পড়লাম। নাহ। এখনো আসেনি ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় তিনটা বেজে গেছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম সাদা রংয়ের ওদের মহিলা কলেজের ইউনিফর্ম পড়া কয়েকজন মেয়ে আসছে ভাবনা ফাস্টফুডের দিকে। তাদের মধ্যে বৃষ্টিও আছে। আমার অস্থিরতা কেনো যেনো বেড়ে যাচ্ছিলো! সবাই এসে বসলো। আমি বার্গারের অর্ডার দিলাম। বৃষ্টি বললো-

- সাথে একটি লাচ্ছিও।

আমি লাচ্ছিরও অর্ডার দিলাম। বৃষ্টি আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমি কখনো এতটা নার্ভাস ফিল করি না। যেটা তখন করছিলাম। বৃষ্টি আর আমি সামনাসামনি বসে আছি। খাওয়ার পর ওর বান্ধবীরা সবাই চলে গেলো। শুধু ও থেকে গেলো। এ কথা সে কথা, কোন নির্দিষ্ট টপিক ছাড়াই আমাদের কথা হচ্ছে। অবশেষে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি চলে গেলো। চলে যাবার সময় বইটি কাল পরশুর মধ্যে দিতে বলে গেলো। আমি ক্যাম্পাসে ফিরে না গিয়ে বাড়িতে গেলাম।

পরদিন সকালে আবারো শহরে এসে বন্ধু প্রিন্সকে নিয়ে তৃপ্তি প্লাজার সায়মন গিফট কর্ণার থেকে একটা বডিস্প্রে আর একটি চিড়ুনি কিনলাম। একটা ছোট্ট কাগজে মহাদেব সাহার একটি কবিতার কটি লাইন লিখলাম-

- বহুদিন ভালোবাসাহীন, বহুদিন উথাল-পাথাল ...

তারপর বৃষ্টির সেই বইসহ গিফটগুলো একসাথে প্যাকেট করে নিলাম। প্রিন্সকে নিয়ে মহিলা কলেজের হোস্টেলে গিয়ে বৃষ্টিকে খোঁজাখুঁজি করলাম। ও বাড়িতে চলে গেছে শুনে মনটা খারাপ হলো। গিফট বক্সটা সায়মনে রেখে আমি ওই দিনই ক্যাম্পাসে চলে আসি।

ক্যাম্পাস থেকে প্যাকেজ ট্যুরে আমরা কয়েক বন্ধু যাই আগ্রায় তাজমহল দেখতে। দশদিনের প্যাকেজ ট্যুর থাকায় দশদিনই মোবাইল বন্ধ থাকে আমার। এগারদিনের মাথায় মোবাইল চালু হওয়ার সাথে সাথে মিস কল এলার্ট থেকে একের পর এক এসএমএস আসতে থাকে। চেক করে দেখি আন-নন একটি নম্বর থেকে পঞ্চান্ন বার কল এসেছে। আমি সেই নম্বরে কল দিলাম। মহিলা কলেজের সামনের সেটি ফোন-ফ্যাক্সের দোকান। বুঝতে বাকি রইলো না এটি বৃষ্টির ফোন ছিলো। আমি ঢাকায় না গিয়ে মানিকগঞ্জ নেমে পড়ি। বৃষ্টির সাথে দেখা করার জন্য মনটা ছটফট করতে থাকে।

প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রিক্সায় বৃষ্টিকে ওর হোস্টেলে নামিয়ে দিতে যাচ্ছি। ইচ্ছে হলো বৃষ্টিতে ভিজতে। রিক্সার হুড না নামিয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভিজে চললাম। ভিজতে ভিজতে বাদাম কিনে খেলাম। বৃষ্টি রিক্সা থেকে নেমে যাচ্ছে আর আমার মনটা ছটফট ছটফট করছে। আরো কিছুক্ষণ থাকলে আরো ভালো লাগতো! বল্লাম-

- পরীক্ষা শেষে কি করবে?

- বাড়ি চলে যাবো।

- বাড়িতে যাওয়ার আগে আরেকদিন দেখা করবে?

- কেনো? স্পেশাল কোনো কিছু?

-নাহ। এমনিতেই।

- ঠিক আছে। পরশুদিন বাড়ি যাবো। সেই দিন।

বৃষ্টি ভেজা কাপড়ে হাসতে হাসতে হোস্টেলের ভেতর ঢুকলো। আমি ওর হোস্টেলের গেটে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে এলাম। পরদিন ওদের শেষ পরীক্ষা। তারপরেই বাড়ি চলে যাবে। আমার কেনো দুশ্চিন্তা হচ্ছে? টেনশন হচ্ছে? বুঝতে পারি না। বৃষ্টির মধ্যেই বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাটতে থাকি। আমি বুঝতে পারি না। কিসের টানে এমন হচ্ছে আমার মধ্যে!

তৃপ্তি প্লাজার চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসে আছি। মায়াবি আলো-আঁধারের পরিবেশে বৃষ্টির কণ্ঠে `আমারও পরানও যাহা চায়...` গানটি আমাকে যাদুর স্পর্শে ফেলে দিলো। আমি শুধু শুনছি আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছি। পুরো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আমরা শুধুমাত্র কয়েকজনের জন্য বুকিং দিয়েছি। বৃষ্টি, আমি আর বৃষ্টির কয়েকজন বান্ধবী। চিংড়ির স্যুপের সাথে অন্থন খাচ্ছি সবাই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ইন্ডিয়া থেকে আনা একটি স্বর্ণের `নাকফুল` পড়িয়ে দিলাম বৃষ্টির নাকে। বল্লাম-

- আজ থেকে তুমি আমার `ভাদো`

- ভাদো?

- ভা-তে ভালো, দো-তে দোসর। অর্থাৎ তুমি আমার ভালো বন্ধু।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।