ঢাকা, রবিবার, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩১, ২৮ জুলাই ২০২৪, ২১ মহররম ১৪৪৬

লাইফস্টাইল

পৌষ পার্বণে

ফারুক ওয়াহিদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৪
পৌষ পার্বণে

“পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। ” -কবি সুফিয়া কামাল ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় গ্রাম বাংলার পৌষ পার্বণে শীতের পিঠা খাওয়ার শাশ্বত রূপ অঙ্কন করেছেন এভাবেই।

অগ্রহায়ণ-পৌষ আসে ঘরে ঘরে স্বর্গীয় উপহারের ডালি নিয়ে সংগোপনে দিয়ে যায় সোনালি সম্ভার। রূপসী বাংলার ঘরে ঘরে বয়ে যায় আনন্দের প্লাবন। তৃণের শীর্ষে হাস্যোজ্জ্বল মুক্তার মতো শুভ্র শিশির বিন্দু দেখে মনে হয় মাটি মাতা যেন অশ্রু-ভেজা আঁখি পল্লব উন্মীলিত করে নবান্ন উৎসব এবং পৌষ পার্বণের দিকে চেয়ে আছে। ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন’- যেখানে শীতের পিঠাই প্রধান উপকরণ।

বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাদ্য তালিকায় এক অনন্য উপাদান পিঠা- যা বাঙালির লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যে পিঠা-পুলির গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে আসছে আবহমান কাল ধরে- এসব বাংলার লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ। বাংলা সাহিত্যে ও ঐতিহ্য-প্রেমীদের লেখালেখিতেও পিঠার উল্লেখ রয়েছে। কৃত্তিবাসের ‘রামায়ন’-এ যেমন বাঙালির খাদ্য তালিকায় ‘দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তেমনি মহাভারতে দময়ন্তীর বিবাহভোজের বিবরণেও দেখা যায় ‘সুমিষ্ট পিষ্টক এবং দই’-এর কথা। ময়মনসিংহ গীতিকায় ‘কাজলরেখা’-য় পিঠা হয়ে উঠে অমৃত সমান।

আবহমান গ্রাম বাংলায় উৎসব মুখর হিমশীতল শীতকন্যা আসে আমলকীর শাখায় কাঁপন ধরিয়ে আর ‘অশ্রু পাথার হিম-পারাপার পারায়ে’- সেই শীতের হাঁড় কাঁপানো কুয়াশাচ্ছন্ন কাক-ডাকা ভোরে খেজুর রস খেজুরের গুড়ের তৈরি লোভনীয় নানাবিধ পৌষালি পিঠা বিশেষ করে ভাঁপা পিঠা উনুনের পাশে বসে খাওয়ার স্বাদই অন্যরকম যা অনির্বচনীয়। আগের রাতে নতুন নলেন গুড় আর ঘন দুধে ভিজিয়ে রাখা চিতোই পিঠার আকর্ষণই অন্যরকম! বেশি বেলায় রোদ চড়ে এলে ভিজানো পিঠার স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে বলে দুধ চিতোই পিঠা শীতের সকালে উঠানের কমলা রংয়ের হালকা রোদেলা খড়ের ওপর শীতলপাটি, মাদুর, হোগলা বিছিয়ে বা পিঁড়িতে বসে মিষ্টি রোদ পোহাতে পোহাতে পিঠা খাওয়ার আনন্দ ভুলবার নয়। ঈশ্বরচন্দ্রতো শীতের পিঠা খেতে একবার গ্রামের বাড়িতে যেতে না পেরে আক্ষেপ করে বলেই ফেলেছিলেন, “এবার বছরকার দিনেরে ভাই জুটলো নাকো পুলি পিঠে। ” “পান পানি পিঠা, এই তিনই শীতে মিঠা”- এই প্রচলিত প্রবচনেই প্রমাণ করে পিঠার ব্যাপারে শীতকালই শ্রেষ্ঠ। কোনো কোনো পিঠা অবশ্য সারা বছরই হয়ে থাকে- যেমন- চিতই পিঠা, তেলের পিঠা, ভাঁপা বা ধুপি পিঠা, পাটিসাপটা, ছিটা পিঠা, মেরা পিঠা ইত্যাদি। কিন্তু এই সারা বছরের পিঠাও শীত মৌসুম হলে তার স্বাদটাই আলাদা।

ঋতু বৈচিত্র্যের দেশ বাংলাদেশে নবান্নের মনোরম উৎসব অন্যতম- এটা হলো পৌষপার্বণ যা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সাথে মিশে আছে। অগ্রহায়ণের একটি শুভ দিন দেখে নবান্ন উৎসব করা হয়। নতুন ধানের চাল, গুড় ও দুধ নবান্নের প্রধান উপাদান। আমাদের লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নবান্নের পরিচয় আবহমান কালের এবং গ্রামে সবাই নবান্নকে স্বাগতম জানায়। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মতে নবান্ন তৈরি হবে নতুন হাঁড়িতে আর নতুন চালে রান্না করা ভাত আর ভাতের সাথে খাবার জন্য তৈরি করা হবে নতুন তরিতরকারির ঝোল এবং তা নানা বেজোড় সংখ্যায় যেমন- তিন, পাঁচ, সাত ইত্যাদি সংখ্যার ব্যঞ্জন। রসের আর ক্ষীর পিঠা তৈরি করা হবে নবান্নের উৎসবে। এবাড়ি-ওবাড়িতে সেদিন থাকে পিঠার নিমন্ত্রণ। জামাই, বেয়াই, বন্ধু-বান্ধব কেউই এই নিমন্ত্রণ থেকে বাদ পড়তো না। নিকট আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো হয় পিঠা পায়েস- তাই নবান্ন তাদের সম্পর্ককে করে তোলে আরো গভীর। আসলে এসময় প্রধান আকর্ষণই হলো শীতের পিঠা। পিঠার সাথে রয়েছে আমাদের নাড়ির যোগ- প্রাচীন ঐতিহ্য।

বাংলার মানুষ তাদের আনন্দ ও প্রাচুর্য্য প্রকাশ করতে সময় ও স্থান বিশেষে আলাদা আলাদাভাবে পিঠা উপভোগ করে থাকেন। যেমন নবান্ন উৎসব ছাড়াও মুসলমানদের মধ্যে বিয়ের অনুষ্ঠানে পিঠা তৈরির রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। বিয়ের পর নতুন জামাইয়ের জন্য বাড়ির মেয়েরা তৈরি করতেন নানা জাতের পিঠা। মেয়ে বা ছেলের শ্বশুর বাড়িতে উপঢৌকন হিসেবে আলপনা আঁকা মাটির হাঁড়িতে করে পিঠা পাঠানোর রীতি এখনো রয়েছে। নবান্ন উৎসবে হিন্দু গৃহিণীরা তাদের লক্ষ্মীদেবীর উদ্দেশ্যে নৈবদ্য দেয়। আর খ্রীষ্টানরা প্রধানত বড়দিনকে উপলক্ষ করেই পিঠা আস্বাদন করে থাকেন।

বাংলার পিঠা একটি মুখরোচক উপাদেয় খাদ্যদ্রব্য- যা তৈরির প্রধান উপাদান হলো চালের গুঁড়ো। এই গুঁড়ো তৈরির জন্য কৃষাণী বধু দিনের বেলা আগেভাগেই প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সকালে খেজুর গাছ থেকে নামানো রস থেকে কিছু রস জ্বাল দিয়ে রেখে দেন- যাতে নষ্ট না হয়। দিনের শেষে কাজ সারা হলে তিনি বসে যান চাল গুঁড়ো করার কাজে এবং সেই চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠা তৈরির কাজে। বিশেষ করে রসের সাথে যে পিঠার সম্পর্ক সেগুলো তৈরি হয় সন্ধ্যার সময়। সকালেও তৈরি করা হয়- তবে সন্ধ্যার পিঠা তৈরি মানেই উৎসব। কোনো কোনো সময় সারারাত ধরে চলে পিঠা বানানোর পালা। সন্ধ্যারাতে বাড়ির ভেতরেও চুলোর ধারে গোল হয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে মা-খালা-ফুপু-মামী-চাচীর পিঠা তৈরি দেখা আর হাসি তামাসা গাল গল্পের মধ্যে তা খাওয়ার যে আনন্দ ও সুখ তা বাঙালি সংস্কৃতির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সাজের পিঠার প্রচলন গ্রামেই বেশি। রস দুধ ইত্যাদির সাথে মিশিয়ে সাজের পিঠা ভেজানো হয়- সারারাত ভিজিয়ে পরদিন সকালে সে পিঠার স্বাদই হয় আলাদা। রস ছাড়াও চালের গুঁড়োর সাথে গুড়. দুধ, নারকেল ইত্যাদি মিশিয়ে নানান ধরনের পিঠা তৈরি করা হয়। কোথাও কোথাও মনের সুপ্ত বাসনা বা সৌন্দর্য্যবোধ ফুটিয়ে তোলার জন্য কোনো কোনো পিঠার ওপর সুন্দর সুন্দর নকশাও করা হয়।

শীতের আগমনে শহরের বাসাবাড়িতেও পিঠা বানানো এবং খাওয়া হয়। শহরের বিভিন্ন হাট-বাজার, ফুটপাতে বিভিন্ন টার্মিনালে ভাপা পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায় এবং পাশাপাশি চিতই পিঠা, কুলি পিঠা, পাটিশাপটা, মেরাপিঠা ইত্যাদিও মাঝে মধ্যে বিক্রি হতে দেখা যায়। শুধু শীতেই নয়- সারাবছর পিঠা খাওয়ার সুযোগ রয়েছে। শহরের বেশ কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে পিঠাঘর যেখানে সারা বছরই পিঠা বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি মিলনমেলা, গায়েহলুদ, জন্মদিন, বিয়ে-শাদীসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও পিঠা সরবারাহের ব্যবস্থা করে থাকে পিঠাঘরগুলো।

একসময় গ্রাম-বাংলায় শতশত নামের ধান ছিল- তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। কত যে বিচিত্র্য নামের পিঠা! পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের ঐতিহ্য। পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য গান ও ছড়া প্রচলিত আছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনপ্রিয় মাটির গান ভাওয়াইয়া গানেরও পিঠার প্রভাব পড়েছে- ‘মনটাই মোর পিঠা খাবার চাই। ’

বাংলাদেশে অঞ্চলভিত্তিক পিঠার বিভিন্ন নাম রয়েছে। জনপ্রিয় পিঠার নামগুলো হলো-

আন্দেশা পিঠা, কুলি পিঠা, কাঁঠাল পিঠা, কাঁঠাল পাতার পিঠা, খাস্তা পিঠা, ক্ষীর পিঠা, ক্ষীর পাটিসাপটা পিঠা, গুড় পিঠা, চিতই পিঠা, চন্দ্রপুলি পিঠা, চাল পিঠা, ছানার পিঠা, ছড়া পিঠা, জামাইভোগ পিঠা, জালা পিঠা, ডোবা পিঠা, তিলকুলি পিঠা, তালের পিঠা, দুধচিতই পিঠা, দুধপুলি পিঠা, দৈলা পিঠা, দুধকদু পিঠা, ভাঁপা পিঠা, নকশী পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, পুলি পিঠা, পাকোয়ান পিঠা, পাক্কাশ পিঠা, পাপড় পিঠা, ফুলঝুরি পিঠা, বরফি পিঠা, বড়া পিঠা, ভাঁপাপুলি পিঠা, মেরা পিঠা, মুগপাকন পিঠা, মালপোয়া পিঠা, রস পিঠা, রুটি পিঠা, লবঙ্গ পিঠা, শেওই পিঠা, সিদ্ধকুলি পিঠা, কলা পিঠা, ছাঁচ পিঠা, ছিটকা পিঠা, চুটকি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পানতোয়া পিঠা, মালাই পিঠা, লবঙ্গ লতিকা পিঠা, রসফুল পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, ঝুরি পিঠা, ঝিনুক পিঠা, সূর্য্যমুখী পিঠা, নারকেল পিঠা, দুধরাজ পিঠা, বিবিয়ানা পিঠা(জামাই ভুলানো পিঠা) ইত্যাদি ছাড়াও আরো কত বাহারি নামের পিঠা রয়েছে!

পিঠার স্বাদ গ্রহণ ও জনসমক্ষে বা নতুন প্রজন্মকে একে আরো পরিচিতি করে তুলতে দিনব্যাপী অথবা সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশে ইদানীং শহর-নগরে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রবাসেও বাঙালিরা পৌষমেলা বা পিঠামেলা উৎসবের আয়োজন করে থাকেন। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও মানুষে-মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বন্ধনকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পারে পিঠামেলা উৎসবের আয়োজন।

এ প্রবাসে থেকে শীতের পিঠার মৌসুমে বা পৌষের অপরূপ বাংলা মায়ের রূপের কথা মনে হলে অথবা প্রিয়জনের কথা মনে হলে তখন উদাস মনে মান্না দে-র সেই বিখ্যাত গানের  কলির সাথে ঠোঁট মিলিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে- “পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন, ফিরে আর আসবে কি কখনো? ফিরে আর আসবে কি কখনো!”

 লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক, মুক্তিযোদ্ধা

বন্ধরা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যে অনেকটা অংশ জুড়ে আছে শীতের দিনের মজার মজার পিঠা। আপনার বাড়ির বা এলাকার পিঠার রেসিপি ছবিনহ পাঠান। [email protected]

বন্ধুরা আরও নানা বিষয়ে জানতে ও আপনার মতামত জানাতে https://www.facebook.com/bnlifestyle

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।