বিশ্ব-দরবারে পরিচিত বাঙালি নাম বিবি রাসেল। তিনি তিলে তিলে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়।
সেই মেয়েটি কি না এক সময় হয়ে উঠলেন বিশ্ব-কাঁপানো সফল মডেল। তার চেহারায় যে যাদু, যে আলো, তা ছড়িয়ে গেল বিশ্ব-পরিমণ্ডলে। বিবির শো থাকলে তার জন্য বিমান অপেক্ষা করত, আরাম আয়েশ-অর্থ, খ্যাতি কোনো কিছুরই কমতি নেই। বিবি যখন স্টেজে শত শত ক্যামেরা তার সামনে ঝলসে-ওঠে বারবার। কিন্তু এক সময় তিনি ভাবলেন-অনেক হয়েছে। এবার দেশকে কিছু দেবার পালা।
ফিরে এলেন দেশে। কাজ শুরু করলেন বাংলাদেশের পণ্য দিয়ে। দেশের তাঁত শিল্পকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে আজ দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন বিবি। গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে মানুষের আস্থা অর্জন করেছেন। পেয়েছেন অকৃত্রিম ভালোবাসা। প্রতিদানে তিনি তাঁতীদের দিয়েছেন কাজের নিশ্চয়তা, ন্যায্য বাজার মূল্য, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। বাচ্চার শিক্ষা, চিকিৎসা নেওয়ার অর্থনৈতিক সক্ষমতা।
দুই ছেলে-ছেলের বউ আর নাতি-নাতনী নিয়ে বিবির পরিবার। ছেলেরা নিজেদের মতো প্রতিষ্ঠীত। তারা দেশের বাইরে থাকেন। সময় পেলেই দেশে আসেন যখন মা(বিবি রাসেল) দেশে থাকেন। তবে বিবির সংসার বহু তাঁতী নিয়ে। যাদের সবার হাড়ির চালের খবরও রাখতে হয় বিবির। দেশে বেশির ভাগ সময় একাই থাকেন তিনি। কাজের ফাঁকে বাড়িতে যান শুধু ঘুমাতে। খাবার দাবার নিয়েও তেমন চাহিদা নেই তার। নিজের রান্না করা একটি ঝটপট রেসিপি করে নেন বলে জানান। আচার খেতে পছন্দ করেন। মায়ের হাতে তৈরি পিঠা এখনো মিস করেন। পিঠা তৈরি কেন শিখে রাখেন নি সে আফসোসও করলেন। তবে তার তাঁতী বন্ধুরা তো জানে বিবির পছন্দ, তাই কাঁচা আমের তৈরি বিভিন্ন ধরনের আচার এরই মধ্যে নিয়ে এসেছেন তারা।
বণার্ঢ্য জীবনে বিবি রাসেলের অজর্নের মধ্যে রয়েছে, প্যারিসে ইউনেষ্কোর সহযোগিতায় তার প্রথম ফ্যাশন শো ‘ওয়েভারস অব বাংলাদেশ’। এক বছর পর স্পেনে। সেদেশের রাণীর সহযোগীতায় আয়োজিত হয় বিবির দ্বিতীয় প্রদর্শনী ‘দ্যা কালারস অব বাংলাদেশ’- বাংলাদেশের রং। ১৯৯৮ সালেন সেপ্টেম্বরে ইউনেষ্কো ও ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিলের সহযোগিতায় আয়োজিত হয় ‘ষ্টারস অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে বিবির তৃতীয় প্রদর্শনী। একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও বাংলাদেশের তাঁতীদের মনের রঙের ছোঁয়া আর বিবির স্বপ্নের নকশায় তৈরি পোশাকের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ঘটা করে।
২০০৮ সালে বিশ্বসেরা আটটি ব্র্যান্ড আরমানি, ভেলেন্তিও, পলস্মিথ, কেলভিন ক্লেইন, হুগো বস, ম্যাক্স মারা ও লরেন ব্র্যান্ডের পাশাপাশি ‘বিবি রাসেল নামের ব্র্যান্ড’ও চালু হয়েছে ইউরোপিয়ানদের আগ্রহ এবং অর্থায়নে।
নিজের কাজের জন্য দেশে-বিদেশে নানা স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ১৯৯৭ সালে এলে ম্যাগাজিন তাকে ‘উইমেন অব দি ইয়ার’ ঘোষণা করে। ১৯৯৯ সালে লন্ডন ইনষ্টিটিউট তাকে সম্মানজনক ফেলোশিপ দিয়েছে। একই বছর ‘বছরের সেরা নারী উদ্যোক্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে ফাউন্ডেশন অব এন্টারপ্রেরর উইমেন। বাংলাদেশের তাঁতী ও হস্তশিল্পীদের উন্নয়ন, মর্যাদা বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের কাজে আত্মনিয়োগের স্বীকৃতি হিসেবে এবং ঐতিহ্যবাহী হস্ত ও কারুশিল্পের প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে তার অঙ্গীকারকে সম্মান জানিয়ে ইউনেস্কো বিবিকে তাদের ‘বিশেষ শুভেচ্ছা দূত: ডিজাইনার ফর ডেভেলপমেন্ট’ খেতাবে ভূষিত করে। পজিটিভ নারীদের সঙ্গে এবং স্পেনে কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নারীদের সঙ্গে নিয়ে ‘ফ্যাশন ফর ডেভেলপমেন্ট’ থিমে কাজ করেছেন। ২০১১-তে নিউইয়ার্ক থিওলজ্যিক্যাল সেমিনারি থেকে ‘আরবান এঞ্জেল অ্যাওয়ার্ড’ এবং জার্মানির ভিশন সামিট থেকে ‘ভিশন অ্যাওয়ার্ড-২০১১’ পান বিবি রাসেল।
২০১৩ সালের নারী দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্যভিত্তিক জনপ্রিয় ফ্যাশন বস্নগ 'ফ্যাশনকম্প্যাশন' ফ্যাশনে ব্যাপক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ১০ নারী ফ্যাশন ডিজাইনারের নামের তালিকা ঘোষণা করে। এর মধ্যে এশিয়ার একমাত্র ডিজাইনার হচ্ছেন বিবি রাসেল।
এতো পুরষ্কার আর সম্মাননার মধ্যে বিবি রাসেল সম্মানিত বোধ করেন একজন ডিজাইনার হয়েও বাংলা একাডেমীর সম্মানিত ফেলো পেয়ে।
বর্তমানে বাংলাদেশের তাঁতীদের পাশাপাশি বিবি ভারতের রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজের আমন্ত্রণে কাজ করছেন জয়পুরের তাঁতীদের সাথেও। রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী খাদী পোশাককে আধুনিকভাবে তৈরি করে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিতে ও খাদীকে টিকিয়ে রাখতে বিবি রাসেলকে দায়িত্ব দিয়েছেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী। এ প্রসঙ্গে বিবি বলেন, ভারতের মহান নেতা গান্ধি জি’র পোশাক ছিল খাদি কাপড়ে তৈরি থান। সেই কাপড় তারা আমার ওপর ছেড়ে দিয়েছেন সময়োপযোগী করে তুলতে। এটা একজন বাঙালি হিসেবে আমার জন্য গর্বের। কেননা ওদের দেশে নাম করা ডিজাইনারের অভাব নেই, কিন্তু একজন বিদেশি ডিজাইনারকে যে সম্মান দিয়ে ওরা আমার ওপর নির্ভর করছে এটা অনেক বড় প্রাপ্তি। তিনি বলেন, ওখানে তাঁতীদের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে এই প্রকল্প।
বিভিন্ন রাষ্ট ও সরকার প্রধানসহ, জনপ্রিয় অভিনেতা শাহরুখ, অমিতাভের মতো বলিউডের অনেক বড় বড় তারকারা পছন্দের তালিকায় গুরুত্বের সঙ্গে রাখেন বিবির ডিজাইনের পোশাক। একটি পোশাকের সুতা থেকে সব কিছু নিজে তৈরি করে যেভাবে বিবি কাজ করেন, ভারতের জনপ্রিয় ফ্যাশন ডিজাইনার মনিষ মালহোত্রা পর্যন্ত তার প্রশংসা করে স্বীকার করেন তার পক্ষেও এই সাধনা করে কাজ করা সম্ভব নয়।
বিবির স্বপ্ন জুড়ে শুধুই দেশের তাঁত আর দরিদ্র নারীরা। বিবি স্বপ্ন দেখেন একদিন দেশের প্রতিটি নারী তার যোগ্য মযার্দা আর কাজের সুযোগ ও স্বীকৃতি পাবেন। দেশের মানুষ দেশীয় পোশাক পরবে। এদেশের হারানো ঐতিহ্য আমাদের তাঁত শিল্প সবার কাছে সমাদৃত হবে।
ভবিষ্যতে তিনি কাজ করতে চান দেশের জামদানী নিয়ে। বিবি বলেন, আমাদের দেশের একটি পোশাকের মান এবং স্থায়িত্ব অন্য যে কোনো পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি ভালো।
বিবি সবার প্রতি আহবান জানান, আমরা পাঁচটি পোশাক কিনলে অন্তত দুটি যেন দেশি হয়। তিনি কষ্ট নিয়ে বলেন, আজকাল কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মনে হয় না যে এটা আমাদের দেশি কোনো অনুষ্ঠান, সবার সাজ পোশাক দেখে অনেকের ভুল হতে পারে কোনো সিরিয়ালের শ্যুটিং হচ্ছে ভেবে।
বিবির নিজের কাজ নিয়ে যেমন অনেক তৃপ্তি আছে, তেমনি আছে কিছু হতাশাও। তিনি বাংলাদেশি পণ্য নিয়ে কাজ করেন বলেই বিশ্বে তার এতো সুনাম। অথচ দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আজ পর্যন্ত তাঁতীদের নিয়ে কাজ করার জন্য কোনো ধরনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেনি।
তিনি কিছুটা অভিমানী আমাদের মিডিয়ার প্রতিও। মিডিয়া থেকে অনেক সময় ঈদ এলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় ঈদের জন্য কী কাজ হচ্ছে, এগুলো জানার জন্য। বিবি বেশ কষ্ট নিয়েই বললেন, তবে কি তাঁতীরা শুধু ঈদেই কাজ করবে আর পুরো বছর তাহলে তারা বেকার থাকবে? আমাদের দেশের তাঁতীদের নিয়ে ভালো একটি ডকুমেন্টরিও সেভাবে তৈরি হয় না বলেও দুঃখবোধ রয়েছে তার। তিনি মনে করেন, দেশের মানুষের উন্নয়নে মিডিয়ার রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাংলানিউজকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিবি বলেন, সব মিডিয়ার মধ্যে বাংলানিউজ অবশ্যই দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করছে এজন্যই এই প্রতিষ্ঠানটি ব্যতিক্রম।
সবশেষে বলতে চাই, বিবি আমাদের। আমরা যদি তার সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারি তবে এটা হবে আমাদের ব্যর্থতা। বিভিন্ন দেশ তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভাগ্য-উন্নয়ন করছে। আর আমরা পারছি না, এই গুণী মানুষটির কদর করতে। তার কাজ, মেধা আর দেশের প্রতি আন্তরিকতাকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশের ঐতিহ্যকে সবার সামনে তুলে আনতে।
বিবির প্রতি কৃতজ্ঞতা…বাংলাদেশকে সম্মানের সঙ্গে বিশ্ব ফ্যাশন দরবারে তুলে ধরার জন্য।