ঢাকা: তাহমিনা শৈলী, তানজিনা আনিস প্রেমা, নাজিয়া লোপা ও রোকসানা রশীদ। এই চার নারী উদ্যোক্তার গল্প ভিন্ন হলেও, দু’টি জায়গায় তাদের ভীষণ মিল!
এক, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের শখকে রূপান্তরিত করেছেন স্বপ্নে।
উদ্যোগটি হলো, উদ্যোগ। পরিষ্কার করে বললে- হাতে গড়া ট্রাইবাল গহনা, নজরকাড়া পোশাক, অন্দরসজ্জার বাহারি গাছপালা ও দেশি তাঁতে বোনা শাড়ি নিয়ে একটি বাণিজ্যিক প্রদর্শনী। ‘উদ্যোগ’ শীর্ষক এ ব্যতিক্রমী আয়োজন নিয়ে হাজির হয়েছে যথাক্রমে চার স্বত্বাধিকারীর ‘শৈলী’, ‘স্ট্রিংজ’, ‘বৃক্ষ’ ও ‘সুইট পটেটো’।
রাজধানীর নবাব বাই ওয়েস্টিনের সম্মেলন ভবনে বৃহস্পতিবার (২৫ জুন) শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে সোমবার (২৯ জুন) রোজ সকাল ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। উদ্যোগ নিয়ে আরও কথা হবে, এখন ঝটপট চারটি গল্প শোনা যাক।
গল্প-১
গহনা পরতে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন গহনা বানাতেও। এক কথায় বললে, নিজেই নিজের গহনা বানিয়ে পরতে ভালোবাসতেন। একসময় ভাবলেন, নিজের এই ভালোলাগা অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিলে কেমন হয়!
এভাবেই শুরু হয় তাহমিনা শৈলীর ‘শৈলী’। ২০০৬ সালে স্বপ্নের যে বীজ বুনেছিলেন, সেই স্বপ্নগাছের শাখা-প্রশাখা পরিপূর্ণভাবে মেলতে শুরু করে ২০০৯ সাল থেকে। ট্রেড লাইসেন্স, টিন সার্টিফিকেটসহ অন্য সব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে শৈলী। সেই থেকে চলছে হাতে গড়া ট্রাইবাল গহনার অনলাইনভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠান।
শোনা যাক তাহমিনা শৈলীর মুখে, চীন, নেপাল, ভারত, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে গহনার পাথর আসে। দেশজ উপাদান হিসেবে থাকে হাড়, কাঠ ও মাটি। ঢাকায় শৈলীর নিজস্ব কারখানায় কাজ করেন ১৭ জন কারিগর। আমার ডিজাইন, শ্রম-ঘাম ও কারিগরদের সম্মিলিত প্রয়াসে তৈরি হয় শৈলীর এক একটি গহনা।
দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যপ্রেমীদের মন জয় করে শৈলীর গহনা পাড়ি জমিয়েছে ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে।
সেই সূত্র ধরেই বললেন, জুয়েলারিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্বতন্ত্র্য জায়গা করে নেবে, এটিই আমার স্বপ্ন!
গল্প-২
‘আমার সবসময় নিজের জামাকাপড় নিজেই বানিয়ে পরতে ভালো লাগে। একসময় খেয়াল করলাম, বানানোর পর পরাপরি নিয়ে অত আবেগ কাজ করছে না। কেবল বানাতেই ভালো লাগছে’।
নিজের শখকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার শুরুটা এভাবেই বললেন স্ট্রিংজের তানজিনা আনিস প্রেমা। দু’বছরে পড়লো স্ট্রিংজ। এটিও অনলাইনভিত্তিক। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে রুচিশীল সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি ও পার্সের চাহিদা মিটিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাকিটা শোনা যাক প্রেমার মুখেই, আমি মিশরীয়, মুঘল ও ট্রাইবাল আর্ট নিয়ে কাজ করেছি। দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে সেসবের মেলবন্ধন ঘটানোর চেষ্টা করি। আরামের কথা চিন্তা করে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কটনই বেছে নিই। সবসময় মাথায় থাকে কাপড়গুলো যেন সব জায়গায় আর সবসময় পরা যায়।
ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ভবিষ্যতে ফ্যামিলি প্যাকেজ ও বাচ্চাদের কাপড় নিয়ে কাজ করারও ইচ্ছে রয়েছে বলে জানান প্রেমা।
গল্প-৩
উদ্যোক্তা হিসেবে নাজিয়া লোপা বাকিদের তুলনায় সবচেয়ে নবীন। প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘বৃক্ষ’র বয়স মাত্র তিনমাস হলেও, বৃক্ষের বৃক্ষগুলো মোটেও নবীন নয়। এতদিন তার একার শখ-আহলাদেই বেড়ে উঠছিল সেগুলো। খেয়াল করলেন, তার চারপাশের মানুষের মধ্যে অনেকেই তার মতো বৃক্ষপ্রেমী।
লোপার মুখ থেকে শুনলে, আমার প্রিয় গাছগুলোর ছবি যখন আমি ফেসবুকে দিতাম, তখন বন্ধুরা খুব প্রশংসা করতো। গাছ নিয়ে তাদের ভালোবাসা ও আগ্রহের কথা জানাতো। অনেকে সংগ্রহও করতে চাইতো। এভাবেই ব্যক্তিগত অঙ্গন থেকে বিষয়টি অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে দেওয়ার কথা মাথায় এলো।
আর এটি বিশেষ করে ঢাকার বাস্তবতায় ভীষণ প্রয়োজনীয় বটে। যেভাবে দূষণ বাড়ছে, সেখানে প্রত্যেকে যদি অন্তত একটি গাছও লাগাই, তাহলে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। ঢাকায়তো ওইভাবে গাছ লাগানোর সুযোগ নেই। এজন্য বৃক্ষ বিভিন্ন টবের গাছই হাজির করেছে। এগুলো বাসার ভিতরে, ব্যালকনি বা ছাদ- যেকোনো জায়গায় রেখে খুব সহজে পরিচর্যা করা সম্ভব, যোগ করেন লোপা।
বৃক্ষের সংগ্রহে রয়েছে তিন প্রজাতির শাপলা, তিন প্রজাতির পদ্ম, চার-পাঁচ প্রজাতির ক্যাকটাস, দেড়শো প্রজাতির ইনডোর প্ল্যান্টসসহ নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি গাছ।
গল্প-৪
বাঙালি বধূর উনুনে যেমন মিষ্টি আলু ছাড়া কড়াই চড়ে না, তেমনি শাড়ি ছাড়া বেমানান নারী! ২০১৪ সালের পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু হয় এ যুগলবন্দির পথচলা, অর্থাৎ রোকসানা রশীদের দেশি তাঁতে বোনা শাড়ির অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘সুইট পটেটো’।
কীভারে শুরু, প্রশ্নের উত্তরে রোকসানার উত্তর, যত দিন যাচ্ছে বিদেশি কাপড়ের আগ্রাসন তত বাড়ছে। অন্যদিকে, চাকরি না করে নিজেই কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এ দুই মিলেই বলা যায়, বিদেশি কাপড়ের বিরুদ্ধে পাল্টা অবস্থান তৈরি করতেই এ প্রয়াস। প্রথমে তো শখের বশে অল্পকিছু শাড়ি নিয়ে নিজেদের মধ্যেই ছিল, পরে গন্ডি বড় হতে হতে ক্রেতার চাহিদাও বাড়তে লাগলো। এভাবেই দাঁড়িয়ে গেল সুইট পটেটো।
যোগ করলেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও, আমরা সরাসরি তাঁতিবাড়ি থেকে শাড়ি নিয়ে আসি। ফলে টাকাটা একেবারে তাঁতির হাতেই যায়। কোনো মধ্যসত্বভোগী থাকে না। এদের ফলেই তাঁতিরা তাদের ন্যয্য দাম পান না। তাঁতশিল্প টিকিয়ে রাখতে হলে তাদেরকেও তো টিকিয়ে রাখতে হবে।
এই ‘আমরা’ বলতে, রোকসানা রশীদ ও নওশাদ হক তিয়াস দম্পতি। ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ দর্শনেই সুইট পটেটো আজ এই অবস্থানে। যদিও উদ্যোক্তা হিসেবে রোকসানাই নানাভাবে সামনে চলে আসেন, কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে তিয়াসকেও টেনে আনতে ভোলেন না!
আর সুইট পটেটোর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জিজ্ঞেস করতে জানালেন, শাড়ি ছাড়া অন্যকিছু ভাবছি না। দেশি শাড়িকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিতে চাই!
গল্প শেষ, ফিরে আসি ‘উদ্যোগ’র কথায়। হ্যাঁ, এটি তাদের দ্বিতীয় আয়োজন। এর আগে, প্রথম আয়োজন ছিল গেল বৈশাখে।
মিরপুর থেকে প্রদর্শনীতে এসেছেন চাকরিজীবী মির্জা সজীব রায়হান ও গৃহিণী নওরীন রহমান। চাকরিজীবী অনন্যা আফরিন এসেছেন নিকেতন থেকে।
কথা হলো তাদের সঙ্গে। সবার মতামত সারমর্ম করলে যেটি দাঁড়ায়, এ চার নারীর উদ্যোগ তাদের ভীষণ ছুঁয়ে গেছে। ভবিষ্যতে এমন প্রদর্শনী আরও হোক।
চার নারীর উদ্যোগ নিয়ে আর কিছু বলতে চাই না, বরং নিজেই জেনে আসুন নবাব বাই ওয়েস্টিনের সম্মেলন ভবনে গিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৫
এসএস