রানার জন্ম একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। সে বাবা মায়ের ছোট সন্তান, ছেলে অথবা মেয়ে নয় শুধুই সন্তান ।
অন্য ভাইবোনেরা বাইরে খেলাধুলা করে-স্কুলে যায়। আর রানা মায়ের সাথে রান্নাঘরে কাজ করে। বাইরের পৃথিবী তার কেমন ছিলো? বাড়ির সদর দরজার বাইরে যাওয়া নিষেধ, তাই বাইরের আলো তার দেখা হয়নি তখনো, ততোদিনে বয়স হয়ে গেছে প্রায় ১৩। সে মেনেই নিয়েছিলো, আর যাই হোক ভাইবোনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো।
কিন্তু বড় বোনটার বিয়ের কথা শুরু হতেই..রানা বুঝে গেলো সে আসলে এই পরিবারের লজ্জা। তাকে লুকাতে সবার সে কি চেষ্টা! বোনটাকে যেদিন পাত্রপক্ষ দেখতে এলো, মা আগেই বলে রেখেছেন সে যেন অতিথিদের সামনে না যায়।
বোনটাকে সেদিন এতো সুন্দর লাগছিলো কিন্তু আমি তাকে দেখতেও পারিনি, কথা বলতে বলতে রানার চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। আর মায়ের সাথে সাথে বোনটাও আমাকে বললো, যেন পাত্রপক্ষের কেউ আমাকে না দেখে। সবাই যখন অতিথিদের নিয়ে ব্যস্ত, সেদিনই বাড়ি ছাড়েন রানা।
অপরিচিত শহরে যোগ হয় আরো একটি আশ্রয়হীন নাম, কিন্তু রানা নয় রানী নামে। শুরু হয় নতুন জীবন-নতুন পথ চলা।
রানী মিশে যায় অন্য হিজড়াদের সঙ্গে। কখনো দোকানে দোকানে টাকা তুলে, বিয়ে বাড়ি বা নতুন শিশু হলে সেখানে গিয়ে নেচে গেয়ে বখশিশ দিয়েই দিন চলে তার। তবে খুব সহজ নয় এপথ চলা। প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয় গালিগালাজ থেকে যৌন হয়রানিসহ নানা তিক্ত অভিজ্ঞতার।
এই রানীদের জীবন কি এভাবেই চলতে থাকবে, এমন প্রশ্ন যখন সামনে এলো খোঁজ নিলাম সরকার আসলে তাদের জন্য কি করছে?
সমাজসেবা অধিদফতরের মহাপরিচলাক গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবির জানালেন, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে সরকার হিজড়াদের জন্য দেশের ৬৪টি জেলায়ই কম্পিউটার শিক্ষা, সৌন্দর্য সেবা, টেইলারিং, ব্লক বাটিকসহ নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এসব কাজ শিখে তারা যদি ছোট পরিসরে ব্যবসা করতে চায় তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ঋণ বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও অন্য সাধারণ নাগরিকের মতোই হিজড়ারা যেন শিক্ষার সুযোগ পায় এজন্য সরকার স্কুলগামী হিজড়া শিক্ষার্থীদের চার স্তরে (জনপ্রতি মাসিক প্রাথমিক ৩০০, মাধ্যমিক ৪৫০, উচ্চ মাধ্যমিক ৬০০ এবং উচ্চতর ১০০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দিচ্ছে।
আর ৫০ বছরের বেশি অক্ষম ও অস্বচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৪০০ দিয়ে থাকে। গাজী মোহাম্মদ নূরুল কবিরের কাছে প্রশ্ন করলাম, এই দিনে একটা মানুষের ৪০০ টাকায় কি হয়? তিনি বোঝালেন, যে মানুষটার কোনো অবলম্বন নেই, একটি ওষুধ কিনতে হলেও অন্যের দিকে হাত পাততে হয়, তিনি যখন তিন মাস পরপর ১২০০ টাকা পান এটা তাকে পরিবারে একটা সম্মান এনে দেয়। আমাদের মতো স্বল্প সম্পদের দেশে এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি হয়তো কিছু করা যাচ্ছে না। তবে হিজড়াদের বিষয়ে আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সামনে।
হিজড়াদের স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার নিয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা বন্ধু ওয়েলফেয়ার সোসাইটি।
সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী সালেহ আহমেদ বলেন, সরকার ২০১১ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দিয়েছে এটা অবশ্যই অনেক বড় উদ্যোগ। কিন্তু কাদের হিজড়া বলা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ডেফিনেশন(সংঙ্গা) দেয়া হয়নি। যেহেতু সরকারি-বেসরকারিভাবে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন কাজের সুযোগ দেয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে এজন্য এখনই হিজড়াদের ডেফিনেশন স্পষ্ট করতে হবে।
বন্ধুর পরিচালক-প্রোগ্রাম ফসিউল আহসান শিক্ষার্থী হিজড়াদের জন্য সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেন, অন্যান্য শিশুদের মতো হিজড়াদেরও যেন হিজড়া পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি করা হয়। হিজড়াদের শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে স্কুল কমিটি, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরত্ব দেন তিনি।
সব শেষে বলতে চাই, হিজড়ারা তো আমাদেরই একজন। এদের দেখে মুখ ফিরিয়ে না থেকে, আসুন ভালবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিন।