সুলতানি আমলে মানসিংহের হাত ধরে বাংলায় প্রবেশ ঘটে আচারের। বাংলার অঞ্চল ভেদে পাওয়া যায় হরেক রকম আচার।
চাটনি আর আচার দুই বস্তু। আর মজার বিষয় হলো, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন খাবারের একটি হলো এই আচার। তুলনায় চাটনি বেশ নবীন।
ফল কেটে রোদে শুকিয়ে তেল মশলা দিয়ে আচার বানিয়ে সব পরিবারই তুলে রাখে সারা বছর খাওয়ার জন্য। তবে চাটনি বাংলার নিজস্ব হলেও আচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পশ্চিম ভারতের নাম। পশ্চিম ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায়, বিশেষ করে কাশ্মীর, রাজস্থান ও পাঞ্জাবের মানুষের সংস্কৃতিতে আচারের প্রচলন আছে।
সেসব ঊষর মরুভূমি অঞ্চলে সেইভাবে চাষবাস হয় না বলে আচারের মাধ্যমে নানা ধরনের সবজিকে সংরক্ষণ করা হয়। সংরক্ষিত ফলের আচার তাদের খাদ্যের অন্যতম অংশ।
বাংলাদেশে মাছ-ভাতের পর ‘আইষ্টা ওঠাইতে টক-মিষ্টি চাটনি’ চলে। চাটনিকে মূল খাবারের অংশ বলা যায় না, বলতে হয় হজমের অনুঘটক বা খাবারের সহযোগী। পশ্চিম ভারতে অবশ্য আচার প্রধান খাদ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
আচার ও চাটনি নামক খাদ্য দু'টি চরিত্র ও বৈশিষ্টগত দিক থেকে আলাদা এবং এগুলো তৈরির পদ্ধতির মধ্যে পার্থক্য আছে। আচারের ক্ষেত্রে উপাদানকে প্রথমে রোদে কিছুদিন শুকিয়ে নিতে হয়, যাতে এর মধ্যকার জলীয় অংশ না থাকে। চাটনি তৈরি করা হয় একদিনের খাবারের জন্য। তাই চাটনিকে অনেকে বলে ‘এক চাটন’।
ঐতিহাসিকভাবে আচার প্রচলিত ছিল বণিক অথবা যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে, যারা আবাস ছেড়ে শুকনা খাবার নিয়ে দূর-দূরান্তে পাড়ি দেন। তাদের খাদ্য ভাণ্ডারে অবশ্যই আচার থাকতো।
ইতিহাসবিদদের মতে, পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবার আচার। ২৪০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সময়কাল থেকেই মানুষ আচার খাওয়া শুরু করে। ফলে এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবারের একটি। আবার পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবার আচারের ভেতর প্রাচীন উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় শসার তৈরি আচারের কথা।
ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব ২০৩০ সালে মেসোপটেমিয়ায় শসার আচারের প্রচলন ছিল।
এমনও জানা যায়, মিশরের সুন্দরী ও রাজনৈতিক কুশলী রানি ক্লিওপেট্রা আচার খেতেন, যা তিনি প্রেমিক ও রোমান বীর জুলিয়াস সিজারকেও খাওয়াতেন। রানি ক্লিওপেট্রা আচার খেতেন সৌন্দর্য রক্ষা করার জন্য। সিজার খেতেন প্রেমিকাকে তুষ্ট করার জন্য। ইউরোপে সিজারের কাছে আচার অবশ্যই অপরিচিত ছিল। খাদ্য হিসাবেও সেটি পশ্চিমা মুখে উপাদেয় হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রেম ও প্রণয়ের তোড়ে তা-ও খেয়েছিলেন সিজার!
সিজারকে হত্যার পর রোমান ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় আরেক যোদ্ধা মার্ক অ্যান্টনির হাতে। অবাক ব্যাপার হলো, সিজার-প্রণয়িনী মিশর-সুন্দরী রানি ক্লিওপেট্রা কিন্তু অ্যান্টনিরও বাহু-লগ্না প্রেয়সী ছিলেন। শেক্সপিয়ারের নাটকে সেসব কাহিনীর রসঘন বর্ণনা রয়েছে।
তবে সিজারের মতো অ্যান্টনিকেও ক্লিওপেট্রা আচারের প্রতি ঝুঁকিয়েছিলেন কিনা, সে তথ্য ইতিহাস জানায়নি! আশ্চর্য্য তথ্য হলো, আচার ছাড়া ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করতে পারতেন না।
১৪৯২ সালের আমেরিকা অভিযানে কলম্বাস তার নাবিকদের রেশন হিসেবে আচার দিতেন। এই আচার তাদের ভিটামিন সি-এর অভাব মিটিয়ে স্কার্ভি রোগের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রায় সুস্থ্য থেকে শেষ পর্যন্ত তারা আমেরিকা আবিষ্কার করেই ছেড়েছিল!
দক্ষিণ এশিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি আচারের প্রচলন দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে। সেখানকার খাবার পরিবেশনের সময় নানা পদের সঙ্গে আচার থাকবেই। বিশেষত, সেখানে নন-ভেজ বা নিরামিষাসীর প্রাধান্য অত্যাধিক।
তারা আমিষের বদলে দুধ, দই আর নানা ধরনের আচার অকাতরে খেয়ে থাকেন। বলিউডের শ্রেষ্ঠ-সুন্দরীদের তালিকায় যেমন দক্ষিণের জয়-জয়াকার, তেমনি ভারতে অগ্রণী মেধাবীরাও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর বাসিন্দা। এসবও কী আচারের গুণ? কে জানে...!
বাংলাদেশ সময়: ১৮২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৭
এমপি/এসএইচ