লন্ডন: লন্ডনে আয়োজিত এক নাগরিক স্মরণ সভায় সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা’র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ব্রিটেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
স্থানীয় সময় রোববার (১২ এপ্রিল) বিকেলে পূর্ব লন্ডনের ব্রাডি আর্টস সেন্টারে প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর সভাপতিত্বে ও সংস্কৃতিকর্মী ইয়াসমিন পলিনের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বাঙালির ইতিহাসের অংশ প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিকের প্রতি এ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রবাসীরা।
সভায় আমিনুল হক বাদশার স্ত্রী আলমা হকসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার গিয়াস উদ্দিন, জয়েন্ট কাউন্সিল ফর ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্রেন্টস’র চিফ এক্সিকিউটিভ হাবিব রহমান, সাংবাদিক সৈয়দ আনাস পাশা, সাংবাদিক ইসহাক কাজল, চ্যানেল আই ইউরোপের প্রধান নির্বাহী রেজা চৌধুরী শুয়েব, মানবাধিকারকর্মী আনসার আহমেদ উল্লাহ, গণজাগরণ মঞ্চের অজন্তা দেব রায় ও সংস্কৃতিকর্মী সাজিয়া স্নিগ্ধাসহ প্রয়াত বাদশার পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা সভায় তার স্মৃতিচারণ করেন।
বাদশার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, বাদশা ছিলো আমার ছোট ভাইয়ের মত। কথা ছিলো আমার মৃত্যুর পর আমার অবিচুয়ারি (শোকগাঁথা) লিখবে সে, ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, আজ তার অবিচুয়ারি আমাকেই লিখতে হচ্ছে।
গাফফার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে বাদশার নাম এমনভাবে মিশে আছে যা কোনোভাবেই আলাদা করা সম্ভব নয়। জাতির জনকের স্নেহধন্য এই ভাগ্যবান সাংবাদিক বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি টার্নিং পয়েন্টের সাক্ষী হিসেবেই ইতিহাসে বেঁচে থাকবে।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা তৈরিতেও আমিনুল হক বাদশার বিশেষ ভূমিকা ছিল জানিয়ে গাফফার চৌধুরী বলেন, রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী সর্বপ্রথম যে পতাকাটি উড়িয়েছিলেন, সেটি আমিনুল হক বাদশার কাছেই ছিলো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরির জন্য যে চারজনকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, বাদশা ছিল তাদেরই একজন।
জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রয়াত বাদশার সম্পর্কের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে হলে বাদশার কাছে ধর্না দিতে হতো। আমাদের কাছে বাদশা ছিলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্যের মতো।
স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ঢাকার অদূরে সাভারে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলায় আমিনুল হক বাদশার সাহসী ভূমিকার স্মৃতিচারণ করে গাফফার চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা ওইদিন সাম্প্রদায়িক হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিলাম। বিশাল এক সাম্প্রদায়িক গুণ্ডা দলকে প্রতিহত করতে বাদশা একা যেভাবে এয়ারগান নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলো তা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে।
ব্যক্তিজীবনে প্রয়াত এই কৃতি সাংবাদিক একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন মন্তব্য করে গাফফার চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে বাদশা অনেক কিছু করতে পারতো, কিন্তু সে তা করেনি। তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিলো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক, এই সম্পর্ককে বাদশা কখনও কলুষিত হতে দেয়নি।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হননের চেষ্টা বা তার ভূমিকা নিয়ে ইতিহাস বিকৃতি আমিনুল হক বাদশা কখনও সহ্য করতে পারতেন না মন্তব্য করে গাফফার চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেখানেই ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টা হতো সেখানেই বাদশার সাহসী গর্জন, আমৃত্যু এটি ছিলো তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পর জয় বাংলা বলেছিলেন কিনা, ইতিহাস বিকৃতির এমন বিতর্কেও বাদশার গর্জন আমরা শুনেছি।
এ প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজে প্রকাশিত আমিনুল হক বাদশার সর্বশেষ সাক্ষাৎকারের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন। মৃত্যুর আগে বাদশা সর্বশেষ সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন বাংলানিউজকে, যা ভিডিও ক্লিপসহ প্রচার করা হয়।
গাফফার চৌধুরীর মতে, সাংবাদিক হিসেবেও আমিনুল হক বাদশার জীবন ছিলো বর্ণিল। তিনি বলেন, সত্তরের নির্বাচনে যে চারজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হয়ে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন, বাদশা ছিল তাদের একজন। দীর্ঘ ১৮ বছর আন্ডারগ্রাউন্ড জীবন শেষে উপমহাদেশের কিংবদন্তি কমিউনিস্ট নেতা মনি সিংহ যখন প্রথম প্রকাশ্যে আসার ঘোষণা দেন তখন তাকে নিয়ে শুরু হয় মিডিয়া তোলপাড়। মনি সিংহকে নিয়ে কার আগে কে এক্সক্লুসিভ রিপোর্ট করবেন সে নিয়ে শুরু হয় নির্ঘুম প্রতিযোগিতা। সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে শেষ পর্যন্ত বাদশাই প্রথম মনি সিংহের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো।
সভা শেষে প্রয়াত আমিনুল হক বাদশা স্মরণে এক বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
গত ৯ ফেব্রুয়ারি দীর্ঘ রোগভোগের পর বঙ্গবন্ধুর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি, মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক বাদশা লন্ডনের অরপিংটন হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৩৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৫
এইচএ/